নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় : আমাদের দায় কোথায়?
ওয়াসিম ফারুক
দিন দিন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা বাড়ছে। অনেক আগে থেকে এই সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে আসছে এদেশে। নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে বলেই দৃশ্যমান। বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অন্তত তাই প্রমাণ করে। কক্সবাজারের রামু থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, তারপর গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে সাঁওতালদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতি বিরাজ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে আগুন সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা করতে হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপর হামলা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়নি। ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মহিমাগঞ্জে পুলিশ ও স্থানীয় ভূমি দখলদাররা একযোগে হামলা চালায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপর। সংবাদমাধ্যমের তথ্য, হামলায় তিন সাঁওতাল আদিবাসীর জীবন দিতে হয়েছে। তবে সাঁওতালদের দাবি নিহতের সংখ্যা আরও বেশি। ৬ নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে মহিমাগঞ্জ চিনিকলের তথাকথিত শ্রমিক-কর্মচারীরা পুলিশি পাহারায় সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারসংলগ্ন এলাকায় জমিতে আখ কাটতে যান। তবে খামারের জমিতে থাকা সাঁওতালরা তাদের বাধা দেয়। এতে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের মধ্যে ধাওয়া এবং সংঘর্ষ বাধে, এতেই ঘটনার সূত্রপাত। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা দেখছি, তথাকথিত ওই মানুষদের হিংস্র রূপ। আদিবাসী সাঁওতালদের পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে, একুশ শতকের ডিজিটাল বাংলাদেশে নয়, আমরা বাস করছি আদিম যুগে।
১৯৫৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গাইবান্ধার গোবিন্ধগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি মহিমাগঞ্জ সুগার মিলের জন্য অধিগ্রহণ করে যা সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম নামে পরিচিত। জমি অধিগ্রহণের ফলে মহিমাগঞ্জের ১৫টি আদিবাসী গ্রাম এবং ৫টি বাঙালি গ্রামের আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়। অধিগ্রহণের চুক্তি অনুযায়ী অধিগ্রহণকৃত জমিতে আখ চাষ করা হবে, তবে আখ চাষ করা না হলে এসব জমি পূর্বের মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অধিগ্রহণের পর বেশকিছু জমিতে আখ চাষ করা হয়। চাষকৃত আখ দিয়ে চিনিও উৎপাদন করা হয়। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়মের কারণে ২০০৪ সালে কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পরে নানা সময়ে চলে কারখানা খোলা আর বন্ধের খেলা। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলোÑ চিনিকল কর্তৃপক্ষ পূর্বের চুক্তি ও নিয়মনীতি লঙ্ঘন করেই অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত বিভিন্ন প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে।
অধিগ্রহণের চুক্তি লঙ্ঘন করে আখের চাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমিতে ধান, গম, সরষেসহ অন্যান্য ফসলাদির চাষাবাদ শুরু করে দখলকরীরা। বিভিন্ন সময় পিতা-মাতার ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা বিষয়টি প্রশাসনকে অবহিত করে। এমনকি আন্দোলনেও পর্যন্ত নামেন। জনগণের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকা সরেজমিনে তদন্ত করেন। তদন্তে তিনি সেখানকার জমিতে আখের পরিবর্তে অন্য ফসলের আবাদ দেখতে পান। এরপর থেকেই নিজেদের ভিটেমাটি ফেরত পাওয়ার আন্দোলনে নামেন উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। আন্দোলনের অংশ হিসেবে উচ্ছেদ হওয়া সাঁওতাল আদিবাসীরা ২০১৫ সালে সেখানে বসতি স্থাপন শুরু করেন।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদের রক্ত আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের সম্মিলিত ত্যাগ ও লড়াইয়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান কাউকেই ছোট করে রাখার বা দেখার অধিকার দেয়নি। আমরা কি সংবিধানের বিধান মানছি? একাত্তরে পাকিস্তানি হায়েনাদের লুটতরাজ আর অগ্নিসংযোগ ছিল মামুলি ব্যাপার, তবে একসঙ্গে এত ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা বোধহয় একাত্তরেও ঘটেনি। আজ তীরন্দাজ সাঁওতালদের তীর ছোঁড়াকেই বড় করে দেখছেন আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
আজ হাজারো সাঁওতাল খোলা আকাশের নিচে অনাহারে দিনযাপন করছেন, দ্বিজেন টুডু চোখে বুলেটবিদ্ধ হয়ে হাতে পুলিশের হাতকড়া পরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। যদিও আদালত সদয় হয়ে দ্বিজেনের বাঁধন খুলে দিতে বলেছেন। আজ সাঁওতাল শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য কাজে যেতে পারছে না, রাস্তায় পর্যন্ত হাটা-চলা করতে পারছে না দখলদারদের হুমকি-ধামকি আর আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের ভয়ে, এ ঘটনাগুলো কি অমানবিক নয়? খুব সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে যৎসামন্য ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মহিমাগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে কিন্তু ব্যক্তিত্বে বিশ্বাসী, নৈতিকতায় বলিয়ান সাঁওতালরা তা গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজ অনেক সাঁওতাল পরিবারই রাগে, ক্ষোভে আর ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলছে। কেন একটি স্বাধীন দেশ থেকে একটি জনগোষ্ঠী নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করবেন? দায় কার এখানে? রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের প্রশাসন কি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে?
একুশ শতকে এসে আমাদের এ সমাজ তথা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে পাল্টাতে হবে। ধর্ম বা জাতি হিসেবে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু কাউকেই ছোট করে দেখলে চলবে না। সবাইকেই তার সাংবিধানিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করতে হবে। যারাই এ ধরনের বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের উপযুক্ত বিচার করতে হবে। লাখো শহিদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশ হোকÑ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সাঁওতাল এদেশে বসবাসকারী সব জনগোষ্ঠীর। সবার প্রত্যাশা এখন এটাই।
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান