সুফিবাদ ও পবিত্রতা অর্জন
সৈয়দ রশিদ আলম
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া এবং একাধিক দেশ ভ্রমণ করে, একাধিক খানকাহ শরিফ, দরবার শরিফ পরিদর্শন করে, সুফিবাদের তৃপ্তি খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যেখানে গিয়েছি, আমার দুর্ভাগ্য নকল মুদ্রার মতো, নকল সুফিবাদের সাক্ষাৎ পেয়েছি। নবী করিম (স.) ব্যক্তিগতভাবে স্বল্প আহার করতেন, কম কথা বলতেন, কম নিদ্রায় যেতেন, রাব্বুল আলামিনের ইবাদত বন্দেগি ও ধ্যান সাধনায় সময় অতিবাহিত করতেন। ২৩টি বছর তিনি হেরা পর্বতে গিয়ে ধ্যান সাধনা করেছেন। নবী করিম (স.) এর একদল সাহাবি যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তারা মসজিদুন নববিতে থাকতেন, ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে মেনে নিতেন, নবী করিম (স.) কে দেখার পর তাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার যন্ত্রণা দূর হয়ে যেত।
এই আসহাবে সুফফারা কুরআনের নূর ও রাসুল (স.) এর শিক্ষা বুকে ধারণ করতেন, লালন করতেন ও পালন করতেন, সেখান থেকে শুরু সুফিবাদের চর্চা। পরবর্তীতে আশেকে রাসুল (স.) হজরত ওয়ায়েজ করনি (রা.) সুফিবাদের চর্চা করতেন। তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ, সম্বল ছিল আল্লাহ ও তার রাসুল প্রেম। মায়ের সেবা করে এই মহাপুরুষ রাসুল (স.) এর পাক দোয়া লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে হজরত জুনায়েদ বাগদাদি (র.), মুনসুর হাল্লাজ (র.), ইব্রাহিম ইবনে আদহাম (র.), ইমাম জাফর সাদেক (র.), মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবি (র.), বায়েজিদ বোস্তামি (র.) ও সামসে তাবরেজ (র.) এর সময় থেকে সুফিবাদের চূড়ান্ত চর্চা বিশ্বব্যাপী শুরু হয়। পরবর্তীকালে হজরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) ও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) ও তার শিষ্যরা সুফিবাদকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন।
সুফিবাদের লক্ষ্য, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) এর জীবন আদর্শ অক্ষরে অক্ষরে নিজের জীবনে প্রয়োগ করা ও কুরআনুল কারিমের শিক্ষা নিজের জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে মুমিন প্রথম ধাপ অতিক্রম করে। সেই ধাপটা হচ্ছে শরিয়ত। তারপর তিনি সাধনার মাধ্যমে যে সঠিক পথ খুঁজে পান, সে পথটি হচ্ছে হাকিকত। এরপর তিনি একজন কামেল বুজুর্গের সন্ধান পান, সেই বুজুর্গ তাকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করে দেন, তখন তিনি যে স্তরে প্রবেশ করেন তাকে বলা হয় তরিকত। এরপর তিনি তাকে একটি পথের ঠিকানা দিয়ে দেন, সে পথটি হচ্ছে মারেফাত। এই মারেফাত যারা অর্জন করতে পেরেছেন, তারা নীরব হয়ে যান, সকাল-সন্ধ্যায় প্রভুর কাছে সমর্পিত হওয়ার কৌশলটা জেনে যান। দুনিয়ার কোনো মোহ, লোভ-লালসা, চাকচিক্য, মায়া থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ডানে-বামে তিনি যেদিকে তাকান সেদিকেই প্রভুর অস্তিত্ব খুঁজে পান। এই অস্তিত্ব খুঁেজ পাওয়ার মাঝে তিনি মেরাজ মিলনের তৃপ্তি লাভ করতে থাকেন। তিনি অপেক্ষায় থাকেন কখন প্রভুর চূড়ান্ত ডাক আসবে। সেই ডাকের অপেক্ষায় তিনি থাকেন।
এ ধরনের প্রভু প্রেমিদের অন্তরে আল্লাহ ও রাসুল (স.) ছাড়া কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকে না। দুনিয়ার কোনো আনন্দ, বেদনা তাকে আর স্পর্শ করে না। রাব্বুল আলামিনের প্রেমে তিনি এমনভাবে বিলিন হয়ে যান যেন, তিনি দুনিয়াতে থেকেও দুনিয়াতে নেই। এ ধরনের প্রেমিকদের মহান রাব্বুল আলামিন তার প্রেমের চাদর দিয়ে আবৃত করে ফেলেন। এটাই মুমিনের চূড়ান্ত চাওয়া। এরাই প্রকৃত সুফিবাদের অনুসারী। নবী করিম (স.) নিজেই বলেছেন, যাদেরকে গিয়ে দেখবে, আমার সঙ্গে মিল আছে, আমার জীবনযাপনের সঙ্গে যাদের মিল খুঁজে পাবে, তারাই তোমাদের শিক্ষক। কিন্তু বিশাল বড় দরবার শরিফ, খানকাহ শরিফ যাবেন, দুনিয়ার সেরা খাবার দেখতে পাবেন, কিন্তু দেখতে যদি না পান নবী করিম (স.) এর আদর্শ ও কুরআনুল কারিমের কোনো শিক্ষা, তাহলে আপনাকে বুঝতে হবে আপনি ভুল জায়াগায় চলে এসেছেন। যদিও এই ভুল জায়গাকে খানকাহ শরিফ বা দরবার শরিফ ডাকা হচ্ছে।
হে দয়াময় আল্লাহ, তোমার কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, দয়া করে প্রকৃত সুফিবাদ উপলব্ধি করা ও পালন করার যোগ্যতা তুমি আমাদের দান কর। আমরা যেন পৃথিবী ত্যাগের মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার প্রেমের চাদরে নিজেকে যেন আবৃত করে রাখতে পারি। আমিন।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান