ডা. নুজহাত চৌধুরী
মাকে যেদিন কাওসার ভাই রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সে দিনটির কথা আমার মনে আছে। ওই একটি জায়গায় মা কখনো যেতে চাইতেন না বা হয়তো পারতেন না। সেদিনটা ছিল বাবা-মার বিবাহবার্ষিকী। সেদিনই তাকে যেতে হয়েছিল সেই বধ্যভূমিতে। আমার মনে আছে, মা ফিরে এসে বলেছিলেন যে ওই মাটির উপর উনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। পা ভেঙে এসেছিল, তিনি ভেঙে পড়েছিলেন। সে অনেকদিন আগের কথা। আজকের স্মৃতিসৌধ তখনো তৈরি হয়নি। তখন আমাদের কথা কেউ শুনতে চাইত না খুব একটা। আমরাও তাই বলতে অভ্যস্ত ছিলাম না। তার আবেগ আর ভেঙে পড়া কেউ ক্যামেরায় ধারণ করে ফেলেছেন, এতে মা খুব সঙ্কুচিত বোধ করছিলেন।
আমি তখন অনেক ছোট তবু আমার খেয়াল আছে, আমি মাকে বলেছিলাম এই শোকটা সকলকে জানিয়ে যাওয়াও আমাদের দায়িত্ব। আমি আজও তাই মনে করি। ইতিহাস আর পরিসংখ্যান হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে বইয়ে। কিন্তু যে বিশাল শোকগাঁথা বাংলার ঘরে ঘরে রয়েছেÑ সেই আবেগ, শোক আর অশ্রুর গভীরতা ওরা কীভাবে অনুধাবন করবে যদি আমরা না বলে যাই? সেই শোকের তীব্রতা ওদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ না করলে, ওরা ’৭১-এর রক্তের ঋণ কীভাবে অনুধাবন করবে? অভিমান বা সংকোচে দূরে সরে থাকলে সব হারিয়ে যাবে।
তাই বারবার বলি, সংকোচকে পাশ কাটিয়ে, মানুষের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বলে যাই ’৭১-এর কথা। যতবার বলি প্রতিবার পুরনো ক্ষতকে নতুন করে রক্তাক্ত করিÑ শুধু এইটুকুর জন্য যে, বাংলাদেশ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ’৭১ কে মনে রাখবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, সম্মান জানাবে। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রজন্ম মনে রাখবে ’৭১-এর রক্তাক্ত ইতিহাস, অন্তর দিয়ে অনুধাবন করবে সেই ত্যাগের পরিমাপ, কাঁদবে সেই শোকের তীব্রতায়, ওদের হৃদয়ে দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা জ্বলবে চিরকালÑ এই আশা করি।
লেখক: শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর মেয়ে/ফেসবুক থেকে