সাঁওতাল আদিবাসীদের এটা মর্যাদাসম্পন্ন শেষ প্রতিবাদ
রাজেকুজ্জামান রতন
রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব ছিল সমাজের সবচেয়ে দুর্বল অংশটাকে সুরক্ষা দেওয়া। সেই অর্থে আদিবাসী অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু এরপর নারী-শিশু-বৃদ্ধ তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বটা ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের অংশ হিসেবেই পড়ে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখলাম, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কখনো কখনো রাষ্ট্রের উচ্ছ্বাসে এই অনগ্রসর অংশ হামলা ও হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। নাসিরনগরে এই ঘটনা এবং এর আগে আমরা সাথিয়ার ঘটনা দেখেছি, রামুর ঘটনা দেখেছি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন প্রায়ই। তাতে করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যেমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তাদের দেশত্যাগের একটা হিড়িক পড়ে। একইসঙ্গে ভোটব্যাংক হিসেবে তাদের ব্যবহারের কুফল মানুষের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সাঁওতাল অধ্যুষিত গোবিন্দগঞ্জে যে অংশটা দেখলাম। একসময় নামই ছিল বাগদাফা। বাগদাফা মানে বাগদা ফরেন সেখানে ছিল তার নামে ওই অঞ্চলটা ছিল বলে ওটার নাম ছিল বাগদাফা সেখানে বংশানুক্রম অনুসারে সাঁওতাল অধিবাসীরা বসবাস করত। যখন চিনিকল স্থাপন করা হয় মহিমাগঞ্জ বা রংপুর চিনিকল যেটা বলা হয়। তখন শর্ত ছিল, আখ চাষের জন্য এই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। বলা হয়েছিল, আখ চাষ ছাড়া অন্যকিছু চাষ করা হলে সে জমি ওই জমির মালিককে ফিরিয়ে দিতে হবে।
স্বাভাবিকভাবে যে শর্তে তাদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল সেই শর্ত যখন কর্তৃপক্ষ মানছে না, তখন তাদের কাছে জমি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। এটাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিবেচনা না করে তাদের উপর সরকার দলীয় নেতাকর্মী এবং পুলিশ তাদের উপর যে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, দুর্বলদের উপর নিপীড়ন করার পথ বেছে নিয়েছে তারা।
ত্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিপীড়িত সাঁওতাল মানুষগুলোর শেষ প্রতিবাদ। দরিদ্র মানুষের তো আসলে মর্যাদা আর সম্ভ্রম ছাড়া আর কিছু নেই। তারা সেটুকু দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তাদের কথা হচ্ছে যারা আমাদের নিপীড়ন করলেন, যারা আমাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিলেন, যারা আমাদের গুলি করে ৪ জনকে নিহত এবং অসংখ্য লোককে আহত করলেন, তাদের কাছ থেকে ত্রাণ নিয়ে আমরা নিজেদের অসম্মানিত করতে পারব না। এই ত্রাণ আমরা কি করে গ্রহণ করি? তাদের কথা তোমরা নিপীড়নকারী, তোমাদের কাছ থেকে আমরা ত্রাণ নিতে চাই না। আমরা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি এটা ঠিক, কিন্তু ত্রাণ গ্রহণ করে নিজেদেকে ছোট করতে চাই না। ফলে আমি মনে করি, সাঁওতাল আদিবাসীদের এটা মর্যাদাসম্পন্ন শেষ প্রতিবাদ।
এটা শুধু ত্রাণ ফিরানো নয় তারা সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা চাঁদা দিয়ে আন্দোলন করে, কষ্ট করে, না খেয়ে থেকেছে। কিন্তু কারও কাছে হাত পাতেনি। এটা যদি রাষ্ট্র এবং সমাজ গ্রহণ করতে পারত তাহলে অশুভ শর্তে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে দেশের মানুষকে ঋণের বোঝায় আমরা জর্জরিত করতাম না। প্রতিবছর ৩৪ হাজার কোটি টাকার সুদ এবং আসল শোধ দিতে হতো না এবং অসম্মানজনক শর্তে আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি বিদেশিদের হাতে তুলে দিতাম না। ওই আদিবাসী মানুষগুলো মরতে মরতেও যে শিক্ষাটা আমাদের দিল, এ শিক্ষাটাকে যদি আমরা গ্রহণ করতে পারতাম তাহলে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার মূল্যবোধ এবং চেতনা দিয়ে অগ্রসর হতে পারতাম আমরা।
পরিচিতি: রাজনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ/সম্পাদনা: আশিক রহমান