প্রশাসনকে জামায়াতমুক্ত না করলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে
শাহরিয়ার কবির
সাঁওতালদের উপর যে অত্যাচার, নিপীড়ন চলছে এবং সেখানকার সার্বিক যে পরিবেশ সেটাকে যতই বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা আপেক্ষিক ঘটনা বলা হোক না কেন, সেখানে খুবই ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে আমি সবসময় কথা বলার চেষ্টা করছি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে আরেকটি দল পাঠিয়েছি। আমরা তাদের সার্বিক খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছি। এসব ঘটনার মূল যে রাজনীতি সেটা হলোÑ বাংলাদেশে কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা আদিবাসী সম্প্রদায় থাকতে পারবে না। থাকলে তাদের উপর নির্যাতন হবে, নিগ্রহ হবে, বৈষম্য হবে। এসব ঘটনার মূলে তো একটা রাজনীতি আছে, যে রাজনীতিটাই অনেকে বুঝতে চান না। যেমন নাসিরনগরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের কোন্দলের জন্য এটা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগের কোন্দল কোন জেলাতে নেই? বাংলাদেশে কোন উপজেলা আছে যেখানে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের কোন্দল নেই?
আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের কোন্দল হলে কেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা আদিবাসী সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে? কেন তাদেরকে বলির পাঠা বানানো হবে?
এসব নিয়ে যে রাজনীতিটা হচ্ছে এটা জামায়াতের রাজনীতি। কারণ জামায়াত চায় বাংলাদেশকে হিন্দু শূন্য করতে। জামায়াত বাংলাদেশকে মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান বা জিয়াউল হকের পাকিস্তান মতো … মুসলিম রাষ্ট্র বানাতে। যেখানে মুসলিম ছাড়া আর কেউ থাকবে না। মুসলিম হতে হবে তাও আবার জামায়াতের মওদুদীবাদী অনুসারী মুসলিম, অন্য মুসলিম হলে চলবে না। শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুনের মতো মুসলিম হলে চলবে না, তাদেরকে হতে হবে মওদুদীবাদী, ওহাবিবাদী মুসলিম। আমার কথা হচ্ছেÑ এটা তো ওহাবিবাদীর দেশ না, এটা সুন্নি মুসলমানদের দেশ। এ দেশ মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ সবাই মিলে স্বাধীন করেছে। আমাদের সংবিধানের দায়িত্ব সব ধর্মের, সব জাতিসত্তার সমান মর্যাদা দেওয়া। কিন্তু এখন প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াতের লোকজন বসে আছে। ফলে যেটা হচ্ছেÑ যখনই আওয়ামী লীগের কোনো একটা কোন্দল বা অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটে, তখন তারা সে সুযোগে তাদের এজেন্ডা কার্যকর করছে। আর তাদের মূল এজেন্ডা হলোÑ বাংলাদেশকে হিন্দু শূন্য করতে হবে, আদিবাসী শূন্য করতে হবে। জামায়াতের এই এজেন্ডা যদি বুঝতেই পারি তাহলে তো আমরা জামায়াতকে এদেশে রাজনীতি করতে দিতে পারি না। এছাড়াও আমাদের সংবিধানে যে, অর্ধেক পাকিস্তান অর্ধেক বাংলাদেশ; ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে এভাবে তো একটি দেশ চলতে পারে না। এ বিষয়টা এখন সার্বিকভাবে দেখতে হবে যে, আসুকরণীয়, মধ্যবর্তী করণীয়, সুদূরপ্রসারী করণীয় এ কাজগুলো না হলে কখনো সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পারব না।
একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, এটা তো নতুন কিছু নয়। ২০০০ সাল থেকেই ধারাবাহিকভাবে এ ঘটনাগুলো ঘটে আসছে। যখনই সুযোগ পাচ্ছে জামায়াতিরা, বিএনপিরা হিন্দুদের উপর হামলা করছে। কারণ এসব তাদের জমি পাওয়া যাবে, আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক দুর্বল করা যাবে। এসবের মূল উদ্দেশ্য হলোÑ মওদুদীবাদীদের আধিপত্য বিস্তার করা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা সবাই। কখনো বৌদ্ধ সম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়; কখনো মুক্তচিন্তা ব্লগার, কখনো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, প্রগতি মননশীল ব্যক্তি সবাই কিন্তু এ হামলার শিকার, আক্রমণের শিকার। এজন্য আমরা বারবার বলছি, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনীতি, ধর্মের নামে রাজনীতি বাহাত্তরের সংবিধানে যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, বাংলাদেশেও এখন নিষিদ্ধ করতে হবে। এটা করা না হলে সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী হামলা থেকে আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পারব না। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটতে থাকবে।
সাঁওতালরা যে সরকারের ত্রাণ ফিরিয়ে দিলÑ নিঃসন্দেহে এটা ক্ষোভের কারণ। কেননা যারা অত্যাচার, নিপীড়ন করেছে তারাই এখন ত্রাণ দিতে এসেছে। যারা এসব দুষ্কর্র্ম করেছে তাদের বিচার ও শাস্তি দাবি করছি আমরা। তাছাড়া কেউ যদি কারও জমি উচ্ছেদ করতে চায় তাহলে তো তার বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সাঁওতালরা হচ্ছে এদেশের সব থেকে আদিমতম বাসিন্দা। মুসলমানরা যারা বলে, কেউ মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসেছে, কেউ আরব থেকে; কেউ ঘোড়ার পিঠে এসেছে, কেউ মাছের পিঠে এসেছে, কেউ কুমিরের পিঠে এসেছে। সে যাইহোক, হিন্দু, বৌদ্ধ সব ধর্মের আগে এখানে সাঁওতালরা ছিল। সাঁওতাল বলুন, গারো বলুন এরা তো বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা। এখানে জমির উপর তাদের তো একটা নৈতিক এবং প্রাকৃতিক অধিকার।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছেÑ প্রত্যেক ভূমিহীনকে ঘর দেওয়া হবে, গৃহহীনকে ঘর দেওয়া হবে। সরকারের বা প্রধামন্ত্রী যে নির্দেশ দিয়েছেন সে নির্দেশ তো জানা উচিত ছিল। আর যে ঘর তারা বানিয়েছিল, সে ঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এর জন্য কি কোনো শাস্তি হবে না? যে চেয়ারম্যান বা যে প্রশাসন যারাই এর জন্য দায়ী, তাদের সবাইকেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মানুষকে গৃহহীন করা তো একটা ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় বলে আমি মনে করি। কতগুলো নিরীহ মানুষ তাদেরকে গৃহহীন করে দেওয়া হলো, কয়েক মিনিটে তাদের ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল। এখন তারা গাছতলায়, ভাবা যায় স্বাধীন দেশে এমন কর্মকা-।
আমরা সাঁওতালদের তিনজন নেতাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। তারা এসেছিলেন আমাদের কাছে। আমরা বলেছি, এ বিষয়টাকে মানবিকভাবে দেখতে হবে। আর সাঁওতালদের প্রত্যেকের যে সমান অধিকার ও মর্যাদার বিষয়টা সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের ঘর নেই, যাদের জমি নেই; তাদের ঘর, জমি দিতে হবে। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সরকারের তো একান্ন লাখ একরেরও বেশি খাস জমি রয়েছে। সাঁওতালদের ঘরবাড়ি বানিয়ে দিতে কতটুকুই বা জমি লাগে? বারবার কেন আমাদের এসব দেখতে হয়? সে জন্যই আমরা বলছি, যে চেয়ারম্যান জমি দেওয়া হবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দেয়, প্ররোচণা দিয়ে ভোট নিয়েছে এদের তো বিচার হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশনের আইনেও এটা অপরাধ যে, নির্বাচনের জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কাউকে দেওয়া যাবে না। সেই চেয়ারম্যান মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসব অপরাধ করার পরও সে বহাল, এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আমাদের মনে রাখতে হবে, অগ্নিসংযোগ, হামলা, লুণ্ঠন এগুলো কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।
এটা একটা সাম্প্রদায়িক হামলা। এ হামলা নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর উপর হচ্ছে। তখন এটি নিছক একটি হামলা থাকে না। একটি পরিকল্পিত হামলার পর্যায়ে চলে যায়। এখন আদিবাসী “সম্প্রদায়ের উপর বলুন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বলুন, জাতিসত্তা বলুন, ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের উপর বলুন এদের উপর যেসব হামলাগুলো হচ্ছে; এগুলো একটি রাজনৈতিক পরিচয় হচ্ছেÑ এটা পরিকল্পিত হামলার অংশ। একটি রাজনৈতিক মহল চায়, বাংলাদেশে কোনো অমুসলিম থাকবে না। সাঁওতাল আদিবাসী এগুলো কেউ-ই থাকবে না। বাংলাদেশ হবে পুরো ওয়াহাবিবাদী মুসলমানদের দেশ। সৌদি আরবের মতো, মোল্লা ওমরের আফগানিস্তানের মতো দেশ। এটি আমরা হতে দেব না। এজন্য তো ৩০ লাখ শহিদ রক্ত দেননি।
ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে, প্রশাসনকে জামায়াতমুক্ত না করলে এবং অপরাধীদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে। আর্থসামাজিক, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের যে অভূতপূর্ব অর্জন তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনার প্রেক্ষিতে। তাই এখনই প্রতিরোধের সময়, প্রতিবাদের সময়, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার সময়।
পরিচিতি: ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি
মতামত গ্রহণ: তানভীন ফাহাদ
সম্পাদনা: আশিক রহমান