দলের ভিতরে আবার দল কী!
রবিউল আলম
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের নতুন আহ্বায়ক এলবার্ট ডি কস্তা বলেছেন, দলের ভিতর দল করতে দেওয়া হবে না, শুধু দলের মধ্যেই থাকবে। রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাবান, মেধাবী, সত্তর দশকের ছাত্রনেতা ছিলেন সিলেট অঞ্চলের, নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছি না, তার প্রতি প্রশ্ন ছিলÑ দলের ভিতর দল বানায় কি করে? বিশদ না বুঝে হাজারো জিজ্ঞাসা নিয়ে ওই প্রাক্তন ছাত্রনেতার কাছে হাজির হলাম। তিনি আমার বাড়ির পাশেই থাকেন, একসময় রাজনীতিতে তার অনেক কদর ছিল, এখন আর কেউ মূল্য দেয় না।
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পক্ষ পরিবর্তন করে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যারা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়েছিল তারাও দূরে সরে পড়েছে। এখন তার অবস্থা হয়েছেÑ না ঘরকা, না ঘাটকা। মাঝে মধ্যে রাজনীতির ওই মানুষটির সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা, আলাপ-আলোচনা হয়। সেদিন রাস্তায় দেখা হতেই সালাম দিলাম। কুশল বিনিময় করে এক পর্যায়ে জানতে চাইলাম, আচ্ছা বলুন তো দেখি দলের মধ্যে দল কাকে বলে, আর দলের মাঝে দল বানায় কি করে? তিনি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, এই সহজ বিষয়টা জানো না, তাহলে রাজনীতি করো কি করে? ধরো, তুমি দলের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, নিবেদিত কর্মী হয়ে নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছ। এলাকার মানুষ তোমাকে অনেক ভালো জানে, জনসমর্থন আছে, দল ও সর্বসাধারণকে বোকা বানিয়ে নেতার আশির্বাদে চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর বা এমপির নমিনেশন নিয়ে জয়ী হলে, তখন থেকেই তোমাকে দলের মাঝে দল করতে হবে। তুমি চাও আর না চাও তা তোমাকে করতে হবে!
ধরো, তুমি গরিব অসহায় একজন মানুষ ছিলে, বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতি করতে এসেছ, দলে আধিপত্য বিস্তার করে নমিনেশন অর্জন করেছ, তোমাকে টাকা দিয়ে, শ্রম দিয়ে যারা দলীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাদেরকে তুমি চিনলে এবং মূল্যায়ন করলে সব গোমর ফাঁক হয়ে যাবে, যারা জনসেবার লক্ষ্য নিয়ে তোমাকে নির্বাচনে জয়লাভ করালো, তারা শুধু দলের নেতা-কর্মীদের আবদার, অভাব, অভিযোগ নিয়ে আসবে, যারা নিঃস্বার্থভাবে তোমাকে ভোট দিয়েছে তারা এলাকার সমস্যা নিয়ে আসবে, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা নেই, ঘাট নেই, স্কুল নেই, কলেজ নেই আরও কত কি। একসময় তোমার পাশে কিছু হিতাকাক্সক্ষী এসে হাজির হবে, দল ও জনগণের চেয়েও ওরা অনেক ভালো মানুষ হবে! যেমন মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি, ঠিক সে রকম! তোমাকে অনেক ভালো ভালো উপদেশ দিবে, অনেক টাকাপয়সা আয়ের রাস্তা দেখাবে, দ্রুত ধনী হওয়ার পথ দেখাবে। তুমি শত জটিলতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ওদের টোপে পড়বে, চোখে রঙিন স্বপ্ন, ভুলে যাবে পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো।
কত আর দলের সেবা, জনতার সেবা করা যায়Ñ আমার তো ঘর-সংসার আছে, বৌয়ের ঘ্যানর ঘ্যানর, আত্মীয়-স্বজনের চাহিদা সবকিছু তোমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। চাহিদা পূরণ ও নিজের জন্য কিছু করতে দলের নেতাকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে একসময় মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। তারপরও সমাজে তোমাকে চলতে হবে, তার জন্যই তোমাকে দলের ভিতরে দল বানাতে হবে, দলের চেয়েও তোমার দল শক্তিশালী হতে হবে। যদি কোনো কারণে তোমাকে নমিনেশন না দেয়, তাহলে তোমার দল দিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে। তুমি ছাড়া এই নির্বাচনি এলাকায় আর কেউ জয়লাভ করতে পারবে না। দলের কাছে প্রমাণ করতে হবে, কোনো কারণে দলীয় কর্মীদের চাই চাই থামাতে তোমার লোকজন দিয়ে কিছু উত্তম-মধ্যম দিতে হবে, দলীয় বিভক্তি দমন করতে হবে। তুমি তো এখন আর সলিমুদ্দিন না, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর অথবা এমপি-মন্ত্রী হয়েছ। তোমার যে অনেক কিছু আছে তা দেখাতে হবে, না দেখালে চলবে কীভাবে! আর চলতে হলে তো দলের ভিতরে দল করতে হবে। দলীয় প্রধানের হুকুম সারাজীবন পালন করেছ, এত অর্জনের পরেও দলীয় প্রধান তোমার কথা শুনবে না তা কি করে হয়! আর শুনাতে হলে তো তোমাকে দলের ভিতরে দল করতে হবে, তবে সেই দল হতে হবে দলীয় প্রধানের চেয়েও বড় দল! তোমার দল বড় করতে দলীয় প্রধানের দলের লোকদের অত্যাচার-নির্যাতন করতে হবে, দলীয় প্রধানের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া যাবে না। দলীয় প্রধানের দলকে আর কোনো সাহায্য সহযোগিতা করা যাবে না। নিজের একক আধিপত্য বিস্তারকল্পে দলীয় প্রধানের কর্মীদেরকে বেছে বেছে নিজের দলে আনতে হবে।
দলীয় প্রধানের কর্মীরা তো আদর্শবান, দলের কাছে দায়বদ্ধ, তুমি ডাকলেই কি আর না ডাকলেই কি, ওদেরকে তোমার কাছে হস্তান্তর করেছে দলীয় নমিনেশনের মাধ্যমে, কিন্তু তোমার দলের লোকজন না দিলে থাকবে না। যে কারণে তোমার দলের গুরুত্ব অনেক বেশি থাকতে হবে তোমার কাছে। দলীয় প্রধানের দল তো দেখার মানুষের অভাব নেই। তাই দলের ভিতরের দলটাকে তোমার সৃষ্টি করতে হবে অনেক শক্তিশালী করে। নেতার কাছে জানতে চাইলাম, আপনার এত অভিজ্ঞতা বিফলে গেল কেন? অত্যন্ত সহজভাবে উত্তর দিলেন তিনি। বললেন, অতি চালাকে গলায় দড়ি! একবার দলের কাছে বিশ্বাস হারালে আর খুঁজে পাবে না, আর কেউ বিশ্বাস না করলে, তোমার পরিকল্পনার কোনো মূল্য থাকবে না।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান