প্রকাশে অসম্পূর্ণতার বেদন
হাবীব ইমন
মাতৃকূলের একটি উজ্জ্বল এবং গৌরবের প্রজন্ম অধ্যায় শেষ হলো আজ। তার জানাজা হলো। দাফন হলো। আমি যাইনি। দূর থেকে জন্মঅবধি আমার এ চেনা মানুষটির সঙ্গেই আছি। যে মানুষটিকে আমি দেখেছি, সে মানুষটিকে এখন প্রাণহীন, এইভাবে তাকে দেখতে আমি চেয়েছিলাম না। যাওয়া-না যাওয়া নিয়ে মনের মধ্যে প্রচ- দ্বিধা ছিল, বেশ খচখচে ছিল। সকালে যখন আমার খালার (তার বড় মেয়ে রূপা আন্টি-ছোট মেয়ে দীপা আন্টি) সঙ্গে কথা হলো, আমি ভেজা গলায় বলেছি, আমি পারব না যেতে, আমার দাদুকে এইভাবে নিস্তেজ দেখতে চাই না। আমার কল্পনার ভিতর, আমার মনের ভিতর যে মানুষটি বাস করছে, সেই মানুষটি আমার কাছে এইভাবে সবুজভাবে বেঁচে থাকুক সবসময়।
আমার নানা মারা যায় ২০০১ সালে, তাও ক্যান্সারে। আর নানি ১৯৮৮ সালে। একটি শূন্যতা। একটি অভাব। দাদা-দাদীকেও আমি দেখিনি। আমার নানা-নানিকে যতটুকু দেখেছি, আমার অন্য ভাই-বোনরা সেই অর্থে তাদেরকে পায়নি। নানা-নানু বলতে এই তো আমাদের এই দাদু আর নানু। আমার এই দাদু সবসময় আমাদেরকে প্রচ-রকম আদর-স্নেহ দিয়ে কখনোই ওদের সেই অভাবটা বুঝতে দেয়নি। আমি যখন হসপিটালে কাতরাচ্ছিলাম, শারীরিক কারণে দেখতে যেতে পারেননি, কিন্তু এই মানুষটি নামাজ পড়ে পড়ে দোয়া করেছেন, কেঁদেছেন। প্রতিনিয়ত আমার খোঁজ নিয়েছেন। আমার ছোট বোনের বিয়ের সময় তিনি এসেছিলেন, তার নাতিনের বিয়ে দেখতে, তার নাতিনের জামাইকে দেখতে। সেদিন তার সারল্যপনা দেখেছি। আমার ছোট ভাইয়ের বউকে দেখে সেদিনও কী উচ্ছ্বাস তার। মাঝে মাঝে না, অনেকটা সময় তার হাসি, তার উচ্ছ্বাসগুলো একদমই নিষ্পাপ শিশুর মতো।
অনেক আগের কথা, তখন তিনি বেশ সুস্থ, আমাকে নিয়ে অনেক জায়গায় নিয়ে গেছেন। ডাক্তার দেখাতে। জোহরা ম্যানশনে ডা. রশিদ উদ্দিন আহমেদের চেম্বারে। আইসক্রিম খাওয়াতে। অনেক স্মৃতি। অনেক। জীবনের অনেক হাসিমাখা মুখ দেখেছি, আমার এই দাদুর মতো সৌম্য হাসিমুখ কখনো দেখিনি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি অসুস্থ ছিলেন। মাথার উপর সবসময় ছায়ার মতো ছিলেন। প্রেরণা হয়ে ছিলেন। সেদিন আমার দীপা আন্টিকে বলেছিলাম, আমার সফলতা আমার দাদুকে দেখাতে পারব না। আন্টি বলেছিলেন, পারবে। আমার কথা মিথ্যে হয়নি, পারলাম না আর। শুধু আমাকে নিয়ে নয়, পুরো পরিবারটাকে নিয়ে তিনি অসম্ভব মেতে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে সকালে আমার আরেক খালা হিরা আন্টি কাঁদতে কাঁদতে ফোন করলেন, তার ছোট মামার কত কথা, নিজের মেয়ে-ছেলে কী, ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে, বোনের ছেলে-মেয়ে, সব তার নিজের, সবাইকে অসম্ভব ভালোবাসতেন সবাইকে। ছুটে গেছেন সবসময়। সবার জন্য করেছেন, করার জন্য আপ্রাণ আন্তরিকতা দিয়ে লেগে ছিলেন। অনেকেই তার এখানে থেকে পড়ালেখা করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু আমার কৃপণতা আছে, সেইসবের মূল্যায়নে কী দেখাতে পেরেছি। এই যে আমি তাকে শেষ দেখার ক্ষেত্রে পালিয়ে ছিলাম। কাজের দোহাই দিয়েছি। আমার মা খুব সকালে আমাকে ফোন করে খুব কাঁদছেন, তার বড় একটি আশ্রয় ছিল আমার দাদু। বাবার পর এই মানুষটিই আমার মাকে অধিক ভালোবাসতেন। আমি একলা গেলে বলতেন, ‘পারভীন কই?’ আমার মায়ের নাম পারভীন।
শেষ যখন তাকে দেখতে চাই, ওই সময়টায় বেশ অসুস্থ ছিলেন, কাউকে নাকি ঠিক চিনতে পারছিলেন না। আমাকে দেখে চিনলেন। নানু জিজ্ঞেস করলেন, কে বলেন তো। তিনি বললেন, আমার নাতি। এই চিনতে পারায় কী যে ভালো লাগা ছিল! সেদিন বাসায় ফিরে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম। আমার দাদু ভালো হয়ে যাচ্ছে। তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল। যখনই যেতাম, বলতেন, জোবেদা নাতিকে খিচুড়ি খাওয়াবা না! জোবেদা আমার নানুর নাম। অসম্ভব ভালোবাসতেন আমার এই নানুকে নিয়ে। একটি মধ্যরাত চল্লিশ বছরের তাদের দাম্পত্য জীবনের যবনিকা টেনে গেল। সারাক্ষণ জোবেদা, জোবেদা করত। জোবেদা (নানুর) কাছে সবরকম আবদার ছিল। চা খাওয়ার অসম্ভব নেশা ছিল তার। খুব ভালোবাসতেন। ঘন ঘন চা খাওয়া তার জন্য একটু বারণ ছিল, আমি যাওয়ার পর আমাকে মুচকি হেসে হেসে বলছেন, জোবেদা আমাকে চা দেবে না!
দীপা আন্টি যখন মধ্যরাতে যখন মেসেজ দিলেন, সব শেষ। আমি সত্যি তখন বুঝতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল, কী শেষ। যখন বুঝতে পারলাম, সত্যি সব শেষ। জীবনের খাতায় একটি নাম হারিয়ে গেল। দাদু আমি পারিনি কিছু করতে আপনার জন্যে। শুধুমাত্র চোখের জলে ভাসা ছাড়া … প্রচ- রোদ, কিন্তু আজ সারাটি দিন আমার মেঘলা আকাশ। আর কখনো আপনাকে দেখতে পাব না, এইটা এখনো বিশ্বাস করতে পারি না। জীবনে অনেককে রক্ত দিয়েছি, কিন্তু আমার দাদুর জন্য রক্ত দিতে পারিনি। এই কষ্ট আমি রাখব কোথায়।
কার কাছে গিয়ে ইতিহাস শুনব, কার কাছে গিয়ে আমার পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা জানব। তার কাছেই শুনেছিলাম, আমাদের বড় মা শুধু রতœগর্ভা ছিলেন না, একই সঙ্গে তালুকও ছিল। একসময় তাদের জমিদারি ছিল। সবকিছু নিজের হাতে সামলিয়েছেন। যখন রতœগর্ভা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের সব ভাই-বোনদেরকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন, এই কারণে তিনি রতœগর্ভা পুরস্কার লাভ করেন। সেই সময় নোয়াখালীর চাটখিলে বিশাল সংবর্ধনা দেওয়া হয় আমার বড় মাকে। চাটখিলের সিংবাহুড়া বাড়ি পাশে মেয়েদের একটা স্কুল রয়েছে, ওই জায়গায় কিছু অংশ বড় মা ও আমার দাদুরা দিয়েছে। এরকম অসংখ্য ঘটনা তার স্মৃতির ভিতর থেকে খুঁজে নিয়েছি। সেই একটি ঐতিহ্যবাহী এবং উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের শেষ উচ্ছেদটা হলো আজ, তিনি ছিলেন ওই সময়টার শেষ রক্ষক।
লেখক: কলামিস্ট/ সম্পাদনা: আশিক রহমান