নাফ নদীর ওপারে… আহারে!
শরিফুজ্জামান শরিফ
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে মানুষ হত্যা চলছে, সেটা আমরা জানি। পুরো মায়ানমার জুড়ে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে বলে কেউ কেউ প্রচারণা চালাচ্ছেন, সেটা সত্য নয়। মিয়ানমারের সব এলাকায় মুসলমান ধর্মবিশ্বাসীরা হামলার শিকার হচ্ছেন না। খোঁজ নিয়ে দেখুন। কোথাও, কখনো একজন মানুষকেও বিনা বিচারে হত্যা আমরা সমর্থন করি না। ঠিক সেই কারণে মিয়ানমারে যারা হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছেন, সেটা তার ধর্ম পরিচয়ের কারণে হোক আর জাতিগত পরিচয়ের কারণে হোকÑ সমর্থনযোগ্য নয়। আবার সে যদি দেশের ভিতরে কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে তার দায় প্রতিবেশি কোনো রাষ্ট্রের নেবার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের কাছের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি আমাদের বন্ধু ছিল নাÑ কখনো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দেশটি আমাদের শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। জাতিসংঘে বহু পাকিস্তানপন্থি প্রস্তাব পাশ হয়, এই দেশটির নাগরিক সে সময়ের জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট এর কারণে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষে কাগজপত্র ছিড়ে-ছুড়ে ভুট্টো বের হয়ে যেতে পেরেছিল। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ এসেছে, আমাদের সম্পদ লুটের পরে পাচার হয়েছে এদের সহায়তায়Ñ এদের পথ ব্যবহার করে। ৬৫ সালের যুদ্ধের পরে সামরিক শাসক আইয়ুব খান নাফ নদীর ওপারে বিশাল জায়গা বার্মাকে দেবার কারণে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ওই দেশটির শাসকদের দুর্বলতা ছিল, তার প্রতিদান তারা একাত্তরে দিয়েছে।
মিয়ানমারের শাসকরা বরাবর পাকিস্তানের বন্ধু। কেউ কেউ এই হত্যাকা-ের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৌদ্ধধর্ম বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে উস্কানি দিচ্ছেন, কেউ না বুঝে তাতে পা দিচ্ছি! কেউ কেউ ভুয়া ছবিও পোস্ট করছে! আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। প্রশ্ন তুলছে, মুসলমান হত্যা হচ্ছে, জাতিসংঘ নীরব কেন? ধর্মভিত্তিক বিভাজনের চিন্তা মাথায় রাখা এই প্রশ্নকর্তারা কিন্তু প্রশ্ন করছে না, ওআইসি নীরব কেন? অথবা, ইয়েমেনে জানাজার নামাজে, বিয়ে বাড়িতে সৌদি বিমান হামলার নিহতদের জন্য এদের কোনো শোক নেই।
মিয়ানমারের শাসকরা কখনো ধর্মের কার্ড, কখনো জাতীয়তার কার্ড খেলবে। কাল যদি আরাকানি মুসলমানদের হত্যা করা বন্ধও হয় পরশু অন্যকোনো গোষ্ঠীকে ধরবে। সেখানের রাজনীতি এখনো সেনাদের হাতে, তারা টেনশন জিইয়ে রাখতে পছন্দ করে। এতে রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ পোক্ত হয়। সীমান্ত খুলে দাও বলছি, ঘরছাড়া সিরিয়দের দিকে সৌদির তাক করা বন্দুক দেখে আয়লান কুর্দির বাবা যখন পরিবার নিয়ে সাগরে ভেসেছিল, আমরা হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে সৌদি আরবকে বর্ডার খুলে দিতে কি বলেছিলাম? মনে করতে পারছি না।
মিয়ানমার থেকে আগে যারা এসেছে তারা নানা অপরাধে জড়িয়েছে। ধর্মের পরিচয়ের কারণে সৌদি আরব কি সিরিয়া-ইরাকের শরণার্থীদের তার দেশে আশ্রয় দিয়েছে? সেখানে গত বছর অপরাধ করে যে বাংলাদেশিরা গর্দান হারিয়েছে, তাদের কি মুসলমান বলে মাফ করেছে? শিশু রাকিবের খুনি সৌদি আরবে ধরা পড়ার পরে আমরা তাকে ফেরত এনেছি। ধর্মের পরিচয়ের কারণে সে সেখানে আশ্রয় পায়নি। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। সে নিজ দেশের ভিতরে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রাধান্য দেবে আবার প্রতিবেশির ঘরে নিত্য কলহ তার জন্য অস্বস্তিদায়ক।
বিশ্বের যেকোনো জায়গায়, যেকোনো অজুহাতে নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার সাধ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখবে। নির্যাতনের শিকার কাউকে ঘরে আশ্রয় না দিয়েও তার পাশে দাঁড়ানো যায়, নির্যাতন বন্ধে ভূমিকা রাখা যায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব সেটা দেখিয়েছে। নাফ নদীর ওপারে মানুষ হত্যা বন্ধ হোক। তারা তাদের দেশে নিরাপদে থাকুক।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ফেসবুক থেকে