ভাবতে হবে আশ্রয় কীভাবে দিব, কতদিনের জন্য দিব…
কল্লোল মোস্তফা
মায়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় না দেওয়ার পক্ষে নানা ধরনের ‘যুক্তি’ দেওয়া হয়। যেমনÑ
এক. বলা হয়, রোহিঙ্গারা অপরাধ প্রবণ, তারা চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানান অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাই তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না।
বেশ ইন্টারেস্টিং একটি অজুহাত। যে অজুহাতে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, সেই অজুহাতে তো দেশের অনেককেই লাথি দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেওয়া দরকার কারণ এরা একদিকে নিজেরা রোহিঙ্গাদের চেয়ে অনেক বড় বড় চুরি, লুটপাট ডাকাতি করছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ যেন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে/করতে পারে/বাধ্য হয় দেশের মধ্যে তার পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। অপরাধে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে মানুষের দারিদ্র্য-নিপীড়ন-নিরাপত্তাহীনতা-অনিশ্চয়তা ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। দীর্ঘদিন দারিদ্র্য ও নিপীড়নের মধ্যে থাকলে স্রেফ টিকে থাকার জন্যই অনেকসময় মানুষকে অপরাধমূলক কর্মকা-ে নিয়োজিত থাকতে হতে পারে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তা থেকে আবার বেরিয়েও আসে মানুষ। মায়ানমার কিংবা বাংলাদেশে যে বাস্তবতার মধ্যে রোহিঙ্গাদের থাকতে হয়Ñ তা অপরাধের পক্ষে অনুকূল না হলে বাঙালি/রোহিঙ্গা কেউই অপরাধ করত না, করতে পারতও না। আর এই অপরাধের দোষটা বাংলাদেশের আর দশটা মানুষের যেমন, রোহিঙ্গাদেরও তেমন। এর জন্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আলাদা করে ‘অপরাধ প্রবণ’ ট্যাগ দেওয়া রেসিজম।
দুই. বলা হয়, রোহিঙ্গারা জঙ্গিবাদী রাজনীতির ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘুটি হিসেবে শুধু রোহিঙ্গা না, বাঙালি বা যে কেউই ব্যবহৃত হতে পারেÑ যদি ব্যবহারকারী শক্তি আর ব্যবহারের পরিবেশ/বাস্তবতা/পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। যে সমস্যা বাংলাদেশের নিজস্ব রাজনীতির ও শাসকগোষ্ঠীÑ তার দায় বাহির থেকে আসা জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই, চাপিয়ে দিয়ে এই সমস্যা থেকে মুক্তিও নেই। বরং আশ্রয় শিবির তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা না হলে, জীবনের তাগিদে অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদী শক্তির ঘুটি হিসেবে ব্যবহারের ঝুঁকি আরও বাড়বে।
তিন. বলা হয়, রোহিঙ্গারা আসলে বাংলাদেশের সীমিত সম্পদে টান পড়বে, জনগণের ভাগে কম পড়বে।
বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সীমিত সম্পদের সমান ভাগ কি জনগণ পায়? রোহিঙ্গারা আসুক না আসুক জনগণের ভাগে এমনিতেই কম পড়ছে। এই কম পড়া নিয়ে তো এমনভাবে অনেককে কথা বলতে শুনি না যতটি শুনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে। দুঃখজনক বিষয় হলো, যারা এই ভাগে কম পড়ার জন্য দায়ী তারাই এখন জনগণের ভাগে টান পড়ার অজুহাতে একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আরও এক লক্ষ রোহিঙ্গার পেছনে সারাবছর ধরে যে খরচ হবে, তার চেয়ে কয়েক লক্ষ গুন বেশি অর্থ প্রতিনিয়ত জনগণের ভাগ থেকে লুট করে নিচ্ছে ক্ষমতাবান শাসকেরা, সেই লুট বন্ধ না করে অর্থ-সম্পদ না থাকার যুক্তি দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করার কোনো যুক্তি নেই।
চার. বলা হয়, রোহিঙ্গা সমস্যাটি মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, এর মধ্যে বাংলাদেশের নাক গলানো উচিত হবে না।
মায়ানমারের ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নে যখন সে দেশের একটি জনগোষ্ঠী বিপর্যস্ত, যখন পাশে কাউকে পাচ্ছে না, যখন নিরুপায় হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে প্রবেশ করে/করতে চায় তখন সেটি আর অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকে না। এইটা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেরও সমস্যা। সেই সঙ্গে এটা আন্তর্জাতিক সমস্যাও বটে। কিন্তু তার মানে এই না যে, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করবে। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের দায়িত্ব হলো দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামের মাধ্যমে মায়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা যেন মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী নিজের দেশের জনগণের উপর নিপীড়ন চালানো বন্ধ করে, যেন এমন কোনোকিছু না করে যা প্রতিবেশী দেশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এইটা বললেই যে মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী শুনবে তা না, তা শোনানোর জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, কূটনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সম্পর্ক বিনষ্ট করার হুমকি দিয়ে হলেও মায়ানমারকে বাধ্য করা যায়। তাছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। জাতিসংঘের মাধ্যমেও মায়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগ করা দরকার বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী মায়ানমারের নিপীড়ক শাসকগোষ্ঠী এবং দায়িত্বহীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো দেন-দরবার বা চাপ প্রয়োগের মধ্যে না গিয়ে উল্টো বীরত্ব ফলাচ্ছে অসহায় একটি জনগোষ্ঠীকে পুশব্যাক করে।
বস্তুত নিপীড়ন যখন চলে, যখন একটি জনগোষ্ঠী অপর কোনো জনগোষ্ঠীর দ্বারা নিপীড়িত হয়, যখন রাষ্ট্র সেই নিপীড়ন থামানোর বদলে উল্টো মদদ দেয় এবং ফলে যখন পার্শ¦বর্তী দেশে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তখন পার্শ¦বর্তী দেশটির শাসক ও নাগরিকদের দায়িত্ব তাদের আশ্রয় দেওয়া। কোনো ধর্ম-বর্ণ এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়, বিবেচ্য বিষয় আশ্রয় প্রার্থী জনগোষ্ঠীটি নিপীড়িত কিনা। আশ্রয় দিব কি দিব নাÑ এটা নিয়ে ভাবাভাবির কোনো সুযোগ নেই, ভাবতে হবে আশ্রয় কীভাবে দিব, কতদিনের জন্য দিব, কীভাবে তাদের প্রত্যাবসন করব, কীভাবে নিপীড়ক দেশটির শাসকগোষ্ঠীর উপর চাপ প্রয়োগ করব, কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত করে আশ্রয় প্রার্থীদের সেবা করব, কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর চাপ প্রয়োগ করব যেন যত দ্রুত সম্ভব শরণার্থীদেরকে তাদের নিজ বাসভূমের অধিকার ফিরিয়ে দেব।
দেশের সীমানার ভিতরের নিপীড়িত প্রতিবেশীদের পাশে দাঁড়ানো যদি মানবসমাজের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তাহলে নিপীড়িত ব্যক্তি স্রেফ দেশের সীমানার বাইরের মানুষ বলেই সেই দায়িত্ব হাওয়া হয়ে যায় না। অবশ্য বৃহত্তর মানবসমাজের অংশ হিসেবে যদি নিজেদেরকে অস্বীকার করিÑ তাহলে অবশ্য অন্য কথা।
লেখক: গবেষক ও প্রকৌশলী
ফেসবুক থেকে