মানসিকতার পরিবর্তন ব্যতীত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়
মিল্টন বিশ্বাস
চুক্তির পর পুরো পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৮ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা- সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ্য করা যায়। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সরকার। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষ আজ জানতে পেরেছে শান্তি, গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও অবদানের কথা। ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা স্মরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। শান্তি ও উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুলে ধরার মধ্যে আমাদের নেতৃত্বের সাফল্য গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে গত কয়েক বছর জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে। সেখানে স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। এজন্য দারিদ্র্যবিমোচনে উন্নত বিশ্বের আর্থিক প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্বশান্তির জন্য এখন প্রয়োজন অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ প্রসারী ও প্রজ্ঞাময় কর্মসূচি প্রণয়ন যা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসরূপে গণ্য হবে।
গত বছর (২০১৫) ২৮ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৮ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে পাহাড়ের অবস্থা ‘নাজুক’ বলে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না করায় পার্বত্য অঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে বলে দাবি তার। গত বছর (২০১৪) একইভাবে সংবাদ সম্মেলনে সন্তু লারমার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ৩ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় থাকাকালে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও ভূমি টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বর্তমান মেয়াদে ২০১৪ সালে জুম চাষ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, মহাজনী কারবার ও পর্যটনÑ এ পাঁচটি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এসব হস্তান্তরকরণ যথাযথভাবে হয়নি, আংশিক বা ত্রুটিপূর্ণভাবে হয়েছে। এমনকি রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্যবাসীর মতামত ও স্বার্থকে পদদলিত করে। এছাড়া তিনি তিন জেলায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভূমি আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছেন। সেখানকার উপজাতি নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন। উপরন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিকসংখ্যক কোটা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। তার কথার সূত্র ধরে বলা দরকার, পার্বত্য এলাকার বেশির ভাগ উপজাতি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা গ্রহণ করে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, অনেক সরকারি অফিসে উচ্চপদে আসীন। এ কারণে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমতলবাসীদের তরফ থেকে এই কোটা সুবিধা বাতিলের কিংবা কমানোর যে দাবি উঠেছে তা অযৌক্তিক নয়। ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফরের সময় জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছিল। অথচ পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। গত ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের ‘সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুন্নত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে।
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান