ধর্মের মুক্তির আকাক্সক্ষা আর ধর্মের ব্যবসা সম্পূর্ণ দুই বিপরীত বস্তু
ফিরোজ আহমেদ
গণতন্ত্র মানেই তো অসাম্প্রদায়িকতা, তাহলে কেন গণতন্ত্রের সঙ্গে আলাদা করে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চান? এই প্রশ্নটা প্রায়ই শুনি। সঙ্গে আরেকটা প্রশ্ন আরেকদল লোকে করেন, ‘গণতন্ত্র’ চান না ‘সমাজতন্ত্র’ চান। আরও একটা প্রশ্ন আসে, আপনারা কি ইসলাম বিদ্বেষ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা চান?
প্রথম প্রশ্নটার উত্তরের মাঝেই কিন্তু দ্বিতীয়টারও সমাধান আছে। গণতন্ত্র নিয়ে ভাববার সময়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, প্রথমত এই দেশে কারোই গণতন্ত্র নেই, এমনকি বিত্তবানদের জন্যও না। এইখানে একটা স্বৈরতন্ত্র চলছে। যেকোনো মানুষই ক্ষমতার রোষাণলে পড়লে তাকে আইন, প্রতিষ্ঠান, রীতি, সংবিধান কোনোকিছুই তাকে রক্ষা করবে না। তিনি ক্ষমতাধর হলেও একই কথা প্রযোজ্য। বিরোধী হলে তো কথাই নেই। তাই চাই ন্যূনতম গণতন্ত্র, যেখানে অন্তত কথা বলার এবং নির্বাচন করার ন্যূনতম অধিকার থাকবে। এইটুকু আদিম থেকে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের লঘিষ্ঠ সাধারণ গুনিতক।
কিন্তু এই ন্যূনতম গণতন্ত্রও সকলের জন্য সমান নাও হতে পারে। ষাটের দশকের আগে সংস্কৃতি আর আইন উভয় দিক দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বেশ খানিকটা বৈধ ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিকই ছিল। বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠের বর্ণের একটা গণতন্ত্র সেখানে ছিল। সংগ্রাম সেই গণতন্ত্রের সীমা বর্ধিত করেছে। আজও বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রাম সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি দাসপ্রথার আমলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিকই ছিল। নির্বাচনের সুযোগের কথা ভাবলে ভারত একটা গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু জাতপাত আর সাম্প্রদায়িকতা সেখানে বিপুল। বহু আইনের ফাঁকফোঁকরে সেই জাতপাত আর সাম্প্রদায়িকতা অটুট রাখার প্রাণপণ চেষ্টা আছে। ফলে সেখানে গণতন্ত্রের ন্যূনতম লঘিষ্ঠ গুনিতক শক্তভাবে থাকলেও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম সেখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশেও। এই সংগ্রামগুলো গণতন্ত্রের সীমাটাকে বাড়াবার জন্যই দরকার।
সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিষয়টাকে নিয়ে ভেবেছিলেন একটা দড়ি টানাটানির মতো রাজনীতির মাঠে খেলা; যেমনÑ শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজ আর মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে দড়ির একদিকে টানতে থাকেন, অপরদিকে মালিকরা কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি আর মজুরি হ্রাসের অধিকারের জন্য চাপ দেয় দড়ির আরেক দিকে। সমাজের এটানাটানিতে কখনো এপক্ষ কখনো সেপক্ষ সুবিধাজনক অবস্থায় যায়, এই টান কোনো সঙ্কট বিন্দুতে পৌঁছালে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির জন্ম হয়। এটা অবশ্য এমনি এমনি হয় না, অনেকখানি নির্ভর করে পরিকল্পিত রাজনৈতিক কর্মকা-েরও ওপর।
তবে যতক্ষণ সমাজ শ্রেণিবিভক্ত, গণতন্ত্র সকলের হতেই পারে না। কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য সেখানে থাকবে। তাই দাস মালিকদের গণতন্ত্রে কেবল দাসদেরই গণতন্ত্র ছিল, ম্যাগনাকার্টা ছিল জমিদারদের অধিকারের স্বীকৃতির একটা দলিল। সংগ্রামের মাঝ দিয়েই এর পরিসর ক্রমশ বেড়েছে। সমাজতন্ত্র একটা লক্ষ্য হিসেবে গণতন্ত্র থেকে আলাদা কিছু না। সমাজতন্ত্র আদর্শিকভাবে একটা উচ্চস্তরের গণতন্ত্র। সেখানে পুঁজিবাদের শেষ বৈষম্যমূলক উপাদান শ্রেণিরও বিলোপ ঘটবার কথা। ফলে সমাজতন্ত্র চাই বললেও সবটা বলা হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, কেবল সমাজতন্ত্রের জন্য লড়ছি বললে সবটা বলা হয় না। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম যে স্তরে আছে, সে স্তরে গণতন্ত্রের অন্য যে মৌল উপাদানের অভাবগুলো সমাজ অনুভব করছে, কিংবা যা যা ঘটিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান সংগ্রামগুলো থেকে দৃষ্টি ফেরাতে চাইছে, সেগুলোকেও আমাদের দাবি হিসেবে বলতে হয়।
ধর্মবিদ্বেষ, বিশেষ করে ইসলাম বা আর কিছুর প্রতি অবজ্ঞা, আমাদের মাঝে নেই। তার কোনো প্রকাশও সঙ্গত কারণেই দেখা যাবে না। বাংলাদেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইসলামের বিষয়ে ভাবনা আসে, ভারতের বেলায় তা হিন্দু ধর্ম। দার্শনিকভাবে আমরা মনে করি, সকল ধর্মের বিকাশের মাঝেই ইতিহাসের এক একটা সত্য, মানুষের মুক্তির এক একটা আকাক্সক্ষার স্তর লুকিয়ে আছে। ফলে কেবল রাজনৈতিক সুবিধা বা বিজ্ঞানমনষ্কতা ইত্যাদি প্রদর্শনের স্বার্থে আমরা ধর্মকে হেয় করতে রাজি না। অন্যদিকে, কায়েমী স্বার্থের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে এর মাঝে প্রচুর জঞ্জালও জমতে তাকে। সমকালীন বাস্তবতাকে চিরকালের জন্য আরোপের ফলে উচ্চতর সত্যের কাছে পৌঁছাতে প্রচুর প্রতিবন্ধকতাও সেখানে সৃষ্টি হতে থাকে। বরং মানষের মুক্তির এই চিরায়ত আকাক্সক্ষার সময়োপোযোগী ভাষা প্রদানই নতুন নতুন যুগের রাজনীতিক কর্তব্য। প্রতিটি বান্দা আল্লাহর কাছে সমান এই ভাবনার বৈপ্লবিক তাৎপর্য আছে। অহিংসা পরম ধর্ম, এই ভাবনারও। মানুষের এই দার্শনিক প্রগতির ইতিহাসকে ধারণ না করে, তার চেতনাকে অগ্রসর আমরা করতে পারব, এটা আমরা বিশ্বাস করি না।
রাষ্ট্রকে যদি আমরা মেনে নেই আপাতত সংগ্রামের পাত্র হিসেবে, যেখানে আমরা সকলেই অবস্থান করছি, তাহলে রাষ্ট্রকে এমন চেহারা দিতে হবে যেন ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অপর কেউ গৌণ না হয়, নারী যেন শিকার না হয়, ধর্মনিরপেক্ষতার এর চেয়ে বেশি কোনো মানে নেই। বাংলাদেশে বহু ধর্মের বাস বলেই ভুলভাবে মনে হচ্ছে মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আসলে ধারণাটা ঠিক না। ধর্মনিরপেক্ষতাও যতটুকু আছে, তার সুফল মুসলমানও পাচ্ছেন, এর সীমা বাড়লে মুসলমানও আরও বেশিই সুফল পাবেন। কিন্তু যদি ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ হতো (সেটা একটা অসম্ভব বস্তু আজকের যুগে), কোনটা খাঁটি ইসলাম সেই প্রশ্ন অনিবার্যভাবে সামনে আসত এবং আমরা দেখতাম মুসলমানে-মুসলমানে হিংস্র লড়াই। রাষ্ট্র অস্তিত্বশীল কথাটার অর্থ হলোÑ সে এপ্রশ্নগুলোর উপর নিজেকে স্থাপন করে। এই যুদ্ধ থেকে সমাজকে মুক্ত রেখে কিংবা উত্তরিত করে অন্যসব নতুনতর সংগ্রামের পরিসর নিশ্চিত করে। আসলে করে না, নতুন সব প্রশ্নের মুখে পড়ে শাসকরা প্রায়ই পুরনো হাতিয়ারগুলো ব্যবহার শুরু করে, তখন আমরা যা দেখি তাই সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মব্যবসা। ধর্মের মুক্তির আকাক্সক্ষা আর ধর্মের ব্যবসা সম্পূর্ণ দুই বিপরীত বস্তু।
এই বিষয়গুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলাপ আমাদের করতে হবে। আমাদের সামর্থ্য এখনো সীমিত, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের বিকাশের জন্যই যে দার্শনিক ও ভাবগত প্রকাশ দরকার, সেই কাজেরই অংশ এটা। এমনকি এই ক্লান্তিকর আলাপের পরও, পাঠকের প্রতি অনুরোধ, ২৬ নভেম্বরকে ভুলবেন না। সুন্দরবন রক্ষায় চলে আসুন শহীদ মিনারে। জনরায় জানিয়ে দিন।
লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
ফেসবুক থেকে