আসবাবপত্র নয়, মানসিকতার পরিবর্তন চাই
ইকতেদার আহমেদ
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির আবশ্যিক কর্তব্য দেশের জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা প্রদান। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছেÑ ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যেকোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলে ঘোষিত হতে পারে, এরূপ অন্যকোনো কর্ম। সহজ-সরল ভাষায় বলতে গেলে এর অর্থ দাঁড়ায়Ñ রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে যাদের বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদির সংস্থান করা হয় তারাই হলো প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি। প্রজাতন্ত্রের কর্মে যেমন সরকারের বেসামরিক ও সামরিক চাকরিজীবী রয়েছেন, অনুরূপ সাংবিধানিক পদধারীরাও রয়েছেন। সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে এমন অনেক রয়েছেন যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত, আবার এমন অনেক রয়েছেন যারা রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত।
সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, চিফ হুইপ ও হুইপ, বিরোধী দলের নেতা, সরকারি দলের উপনেতা, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রধান প্রভৃতির নির্বাচন পরবর্তী নিয়োগ লাভ ঘটে। একটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল পরাভূত হলে উপরোক্ত সকল পদে পরিবর্তন অত্যাসন্ন হয়ে পড়ে। এ সকল সাংবিধানিক পদধারীর সরকারি কার্যালয় এবং বাস ভবনের যে অংশটুকু সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় এর সকল ধরনের আসবাবপত্র, কার্পেট, পর্দা, কম্পিউটার, টিভি, এয়ারকুলার, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রভৃতি সরকারি ব্যয়ে সংস্থান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে উচ্চাদালতের বিচারকগণ নিয়োগ পরবর্তী একটি নির্ধারিত বয়স অবধি কর্মে বহাল থাকেন। প্রধান নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনারগণ নিয়োগ পরবর্তী ৫ বছর অবধি পদে বহাল থাকেন। সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও সদস্যগণ এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ পরবর্তী ৫ বছর বা একটি নির্ধারিত বয়সে উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত যেটি আগে ঘটে সে অবধি পদে বহাল থাকেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হওয়ার যোগ্য এরূপ ব্যক্তিকে অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দান করেন। সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে সংবিধান নিশ্চুপ। অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ন্যায় নির্দিষ্ট বয়স অবধি পদে বহাল থাকবেন নাকি রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি সাপেক্ষে পদে বহাল থাকবেন এ বিষয়ে বিতর্ক চলমান। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংবিধানিক পদধারীদের ন্যায় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত সাংবিধানিক পদধারীদের সরকারি কার্যালয় এবং বাস ভবনের যে অংশটুকু সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় এর সকল ধরনের আসবাবপত্র, কার্পেট, পর্দা, কম্পিউটার, টিভি, এয়ারকুলার, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রভৃতি সরকারি ব্যয়ে সংস্থান করা হয়।
সরকারের বিভিন্ন সংবিধিবদ্ধ সংস্থার মেয়াদি পদ এবং মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন বাহিনী প্রধান, অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের প্রধানদের মধ্যে প্রথমোক্ত পদধারীরা একটি নির্ধারিত মেয়াদের জন্য নিয়োগ লাভ করেন এবং শেষোক্ত পদধারীরা নির্ধারিত বয়সে উত্তীর্ণ হওয়া অবধি কর্মে বহাল থাকেন। শেষোক্ত পদধারীদের মধ্যে অনেকে ক্ষমতাসীন দলের মতাদর্শী বিবেচনায় চাকরির নির্ধারিত বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এক, দুই অথবা সর্বোচ্চ তিন মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ লাভ করেন। পূর্বে উল্লেখিত পদধারীদের ন্যায় এ সকল পদধারীদের সরকারি কার্যালয় এবং বাস ভবনের যে অংশটুকু সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় এর সকল ধরনের আসবাবপত্র, কার্পেট, পর্দা, কম্পিউটার, টিভি, এয়ারকুলার, টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগ প্রভৃতি সরকারি ব্যয়ে সংস্থান করা হয়।
এ দেশ বিগত এক শতাব্দী সময় ব্যাপ্তিকালে প্রথমত ব্রিটিশ অতঃপর পাকিস্তানিদের দ্বারা শাসিত হয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশিদের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের শাসনামলে এবং বাংলাদেশ অভ্যুদ্বয় পরবর্তী এক দশক অবধি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত উপরোল্লিখিত পদধারীরা প্রকৃত অর্থেই জনগণকে সেবা দেওয়ার মানসে পদে আসীন হতেন এবং পদের বিপরীতে সরকারি কার্যালয় ও বাসস্থানের যে অংশটুকু সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো এর জন্য প্রাধিকারের অতিরিক্ত কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধাদি গ্রহণ করতেন না। সে সময় পদধারীর পরিবর্তন ঘটলেও সরকারি কার্যালয় অথবা বাসস্থানের যে অংশটুকু সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো এর আসবাবপত্র, পর্দা, কার্পেট প্রভৃতির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তন পরিলক্ষিত হতো না বরং এগুলোর সুরক্ষা সর্বোতভাবে নিশ্চিতের প্রয়াস নেওয়া হতো।
সরকারের যেকোনো কার্যালয়ে ব্যবহৃত আসবাবপত্র গুণগতমান নির্ধারণ পরবর্তী সংস্থান করা হয়। এ সকল আসবাবপত্রের নির্ধারিত কোনো মেয়াদ নেই; তবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মেরামত ও রং করার আবশ্যকতা দেখা দিলে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। যেকোনো কার্যালয়ের আসবাবপত্র একান্তই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে গেলে এতদবিষয়ে সংশ্লিষ্ট যে কমিটি রয়েছে তার দ্বারা তা স্বীকৃত হতে হবে এবং কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিস্থাপনের বিধান রয়েছে।
বিগত প্রায় চার দশক ধরে দেখা যাচ্ছে কোনো ধরনের নিয়মনীতির বালাই বা তোয়াক্কা না করে পদধারীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কার্যালয় ও বাসভবনের যে অংশটুকু কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় এর আসবাবপত্র, পর্দা ও কার্পেট প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা দেশের সাধারণ জনগণকর্তৃক প্রদত্ত করের অর্থ। একজন পদধারীর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যালয় ও বাসস্থানস্থ কার্যালয়ের আসবাবপত্র, কার্পেট ও পর্দার পরিবর্তন কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ধরনের পরিবর্তন জনগণ প্রদত্ত করের অর্থের অপচয় বৈ অন্যকিছু নয়। এ পরিবর্তনের সঙ্গে জনসেবার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বরং এ ধরনের পরিবর্তন একজন পদধারীকে বিলাসবহুল জীবনযাপনে উৎসাহ যোগায়। এমনও দেখা গেছে, একজন পদধারীর আগমন পরবর্তী যে সকল আসবাবপত্র, কার্পেট ও পর্দা পরিবর্তন করা হয়েছে এর গুণগতমান ও মূল্য প্রতিস্থাপিত আসবাবপত্র, কার্পেট ও পর্দার চেয়ে ভালো ও সাশ্রয়ী ছিল। এ বিষয়ে বিভিন্ন কার্যালয়ের অধস্তন অনেকের আক্ষেপ থাকলেও পদধারীরা ক্ষমতাধর বিধায় সে আক্ষেপ সরকার তথা জনগণের স্বার্থরক্ষায় কোনো ধরনের ফলদায়ক অবদান রাখতে পারছে না।
একজন পদধারীর কার্যালয় বা বাসস্থানস্থ কার্যালয়ের আসবাবপত্র, কার্পেট ও পর্দা প্রভৃতি সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুযায়ী পরিবর্তন করা হলে পূর্বেকার সামগ্রী যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক নিলাম বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতার নিকট বিক্রি করার কথা কিন্তু এক্ষেত্রেও দেখা যায়, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার ঘনিষ্টজনদের নিকট নামমাত্র মূল্যে এগুলো হস্তান্তর করা হচ্ছে, যা সরকারকে যুক্তিসঙ্গত রাজস্ব প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত করছে।
সকল পর্যায়ের পদধারীর সরকারি দায়িত্বের অন্যতম হলোÑ নিঃস্বার্থ জনসেবা। কিন্তু একজন পদধারী যদি পদে আগমন পরবর্তী নিয়মনীতি ও বিধিবিধানের ব্যত্যয়ে তার কার্যালয় ও বাসস্থানস্থ কার্যালয়ের সরকারি অর্থে ক্রয়কৃত সামগ্রীসমূহ কোনো ধরনের যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে পরিবর্তন করেন সেক্ষেত্রে সামগ্রীর পরিবর্তন একজন পদধারীর নিকট জনসেবার চেয়ে অনেক বড় কিছু। এ ধরনের বড় কিছু হতে যতদিন পর্যন্ত না একজন পদধারীর নিষ্কৃতি লাভ না ঘটবে ততদিন পর্যন্ত মানসিকতা নয়, আসবাবপত্র ও তদসংশ্লিষ্ট সামগ্রীর পরিবর্তন ঘটতেই থাকবে।
লেখক: সাবেক জজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান