বিএনপির প্রস্তাবিত নির্বাচন কমিশন অনর্জনযোগ্য!
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপির দেওয়া প্রস্তাবনা খুবই অস্পষ্ট এবং দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়। তাদের রূপরেখায় উল্লেখ আছে, ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সৎ, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন’ পাঁচজন ব্যক্তিকে দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। তবে প্রস্তাবে যত সহজে তা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা অনেক জটিল। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত সবাই একমত না হবেন, ততদিন পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আলোচনা কতদিন চলবে? প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তি যাদেরকে নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করার কথা হচ্ছে, তারাই আবার প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ অর্থাৎ নানা গুণে গুণান্বিত লোককে খুঁজে বের করবেন। কিন্তু এতকিছু না করে সার্চ কমিটির পাঁচজনই তো নির্বাচন কমিশনার হতে পারতেন। কাজেই পর্যালোচনা করলে বিএনপির এই পুরো প্রক্রিয়ার মাঝে অনেক জটিলতা রয়েছে। তবে বিএনপির প্রস্তাবের ভালো দিক হচ্ছেÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতি। নির্বাচন এলেই আমাদের এখানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনা বা দাবির ঝড় ওঠে। বিএনপি এবার সে দাবি থেকে সরে এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। বিএনপির প্রস্তাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি না আসা একটি শুভবুদ্ধির উদয়। কিন্তু বিএনপির প্রস্তাবে নেতিবাচক দিক হচ্ছে, অত্যন্ত সুকৌশলে জামায়াতকে রক্ষা করার চক্রান্ত। এর চাইতেও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, আরপিওতে পরিবর্তন। গত ৪০ বছরের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে, সেনাবাহিনীকে রাজনীতি মুক্ত করা। বিশেষ করে বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নিয়ে আসা। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনীতি করেছেন। কাজেই বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে ফের রাজনীতিকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সেনাবাহিনীকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, তা নানা সময় সামরিক শাসকরা বিতর্কিত করেছেন। একসময় মনে করা হতো উর্দু, পাকিস্তান, বিএনপি এবং সেনাবাহিনী একাকার। এ থেকে বের হয়ে আসার পথ জননেত্রী শেখ হাসিনাই দেখিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করবেÑ এটা কর্তব্য। তবে সেই কর্তব্য আরও বিস্তরভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। নির্বাহী বিভাগ কীভাবে দায়িত্বপালন করবে এবং সহায়তা করবে। আমাদের এখানে নির্বাচনি আইন-কানুন অন্যান্য দেশের তুলনায় উত্তম। আমাদের এখানে যখনই কোনো নির্বাচন হয়, তখন নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনার অনেক অভিজ্ঞ। আমরা যাদের ভালো নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দাবি করি, আসলে সবাই একই রকমের। নির্বাচন কমিশনাররা দীর্ঘদিন থেকে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। মনে করা হয়, বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচন কমিশনার বানালে নির্বাচন ভালো হবে। তবে এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করি। নির্বাচন করার যে প্রক্রিয়া, তার সঙ্গে বিচারপতিরা পরিচিত নন। নির্বাচনে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার বিষয়গুলো কোনোদিন কোনো বিচারপতি দেখেননি। কাজেই হাতে-কলমে নির্বাচন করার এবং দেখার অভিজ্ঞতা কেবল প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরই রয়েছে। যাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই, কেবলমাত্র প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ নানা গুণ রয়েছে এমন লোকদের দ্বারা নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন একেবারে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচন কমিশনাররা কেবল সংবিধান এবং আইনের কাছে দায়বদ্ধ। সেই অর্থে নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। নিরপেক্ষ লোক চোর এবং পুলিশের উভয় পক্ষ থাকেন কি? কাজেই দেখতে হবে নিরপেক্ষ লোকটি কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না বিপক্ষের, কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের না বিপক্ষের। ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে টি.এন. শ্যাসান সম্পর্কে বলা হয় সবচেয়ে ভালো নির্বাচন কমিশনার। বেশ কয়েকটি নির্বাচন করে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। সংস্কার করে নির্বাচন কমিশনকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই তিনি বিজেপিতে যোগদান করেছেন। এখন তিনি বিজেপির একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি একজন বিজিপির লোক হলেও তার মনমানসিকতা আগে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। হঠাৎ করে তিনি বিজেপি হননি। মানসিকভাবে তিনি বিজেপিই ছিলেন।
রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনের প্রধান অংশ এবং তারাই নির্বাচন করবে। কাজেই এখানে নির্বাচনের স্টেকহোল্ডার কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোই। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না। নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে তা অনেক সময় নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। যদি সেই রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি থাকে এবং তাদের নেতা-কর্মী কেন্দ্রে উপস্থিত থাকে তাহলে নির্বাচন নিয়ে চিন্তার কিছু থাকে না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই নির্বাচনের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করতে পারেন। কিন্ত তা না করে কেবল সংবাদ সম্মেলনে ১৩ পৃষ্ঠার দাবি উত্থাপন করলে সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচন হবে না। বর্তমানে বিএনপির কী অবস্থা? তাদের তৃণমূলের অবস্থা কী? বিএনপির ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা কমিটি ঠিক আছে কিনা, কমিটিতে কারা আছেন? কারা সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাবেন? তারা কি বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, নৈতিকতা সম্পন্ন। সে ব্যাপারে ভাবা উচিত। (চলবে)
লেখক: উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান