নিপীড়িত হচ্ছে মানুষ : হে প্রভু, তুমি কোথায়?
সৈয়দ রশিদ আলম
নাফ নদীতে নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষসহ নৌকা ডুবি, গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লীতে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না, নাসিরনগরে ভিটেমাটি হারা হিন্দু নারী-পুরুষের কান্না, কন্যার ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে এক পিতার দুপা হারানো, ইয়েমেনে নিয়মিতভাবে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক জোটের বিমান হামলা, সেই বিমান হামলায় মসজিদ, মাদ্রাসা ধ্বংস হয়ে যাওয়া, শত শত শিশুহত্যা, মায়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে রোহিঙ্গাদের আগুনে পোড়া, ধর্ষিত হওয়া, দেশান্তরিত হওয়া, নিষ্ঠুর ইহুদিদের ফিলিস্তিনিদের উপর বিমান হামলা অব্যাহত রাখা, উল্লেখিত আক্রান্ত ব্যক্তিদের একটাই প্রশ্নÑ হে প্রভু তুমি কোথায়? বিশ্ববাসীর শান্তির জন্য গঠিত হয়েছে জাতিসংঘ, যার প্রভু যুক্তরাষ্ট্র, যার সঙ্গে একাধিক আঞ্চলিক প্রভু জন্ম নিয়েছে, যেমনÑ সৌদি আরব, ইসরাইল, চীন, ভারত ও রাশিয়া। এই আঞ্চলিক প্রভুরাও তাই করছেন বা করেছেন যা মায়ানমারের সেনাবাহিনী করছে।
গ্রামের চেয়ারম্যান সাহেবেরা যেমন নিজেদের গ্রামের প্রভু ভাবতে থাকেন, আঞ্চলিক প্রভুরাও একই কথা ভাবতে থাকেন। পবিত্র কুরআনুল কারিমে দুই দানবের কথা বর্ণিত হয়েছে, এরা হলেনÑ নমরুদ ও ফেরাউন, ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন তারা, কিন্তু নিজেদের প্রভু ভাবতেন। রামায়ণে বর্ণিত রাবনও নিজেকে প্রভু ভাবতেন। ওইসব উল্লেখিত প্রভুদের পরিণতি সবাই জানেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সারা পৃথিবীকে যিনি আতঙ্কে রেখেছিলেন, নিজেকে প্রভু ভাবতেন, তিনি হলেন জার্মানির হিটলার। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল, সব আঞ্চলিক প্রভুদের ও তাদের অনুগত প্রভুদের একই পরিণতি হয়েছে। চির পবিত্র, চির মহান, যিনি একেক ধর্ম বিশ্বাসীর কাছে একেক নামে পরিচিত, একমাত্র তিনি চিরন্তন প্রভু। রোহিঙ্গাদের মতো পৃথিবীর সব ধর্ম বিশ্বাসীরা যারা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন, তারা মাথানত করে অশ্রুবর্ষণ করছেন, আর প্রশ্ন করছেনÑ হে প্রভু তুমি কোথায়?
প্রভু কি শুধু, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, প্যাগোডায়, সিনাগগে, গুরুদুয়ারায়? নির্যাতিত, ধর্ষিত, পানিতে ডুবে যাওয়া, আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের পাশে যারা দাঁড়ান তাদের হৃদয় প্রভু কোমলতায় পরিপূর্ণ করে দেন আর যারা ফরিয়াদ করছেন হে প্রভু তুমি কোথায়? তাদের পাশে ওই কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো দাঁড়িয়ে যান। কারণ এই শ্রেণির মানুষের কাছে নির্যাতিত মানুষের হাহাকার সবার আগে পৌঁছে যায়। যুক্তরাষ্ট্র, মায়ানমার, চীন, ভারত, ইসরাইল ও সৌদি আরব প্রার্থনাকারীর ডাকে সাড়া না দিলেও, একজন মহাশ্বেতা দেবী, স্বকৃত নোমান, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও নাঈমুল ইসলাম খানের মতো বিবেকবান, হৃদয়বানরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে যান ও তাদের ডাকে সাড়া দেন। কারণ এই ব্যক্তিত্বরা, ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও ভাষার ঊর্ধ্বে মানুষকে ভাবতে শিখেছেন। পরম করুণাময় প্রভু এদের দ্বারাই কল্যাণকর কাজ করিয়ে নেন। যারা কল্যাণকর কাজ করছেন, তারা নিজেরা জানতে পারছেন না যে তারা যাই-ই করছেন প্রভুর ইচ্ছাতেই করছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতাসীন হচ্ছেন। তারা নিজেদের ছাড়া অন্য ধর্ম বিশ্বাসীদের মানুষ ভাবতে পারছেন না, ভাবতে পারছেন না বলেই রোহিঙ্গা মুসলমান, আদিবাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ ও ইহুদি ধর্ম বিশ্বাসীরা প্রতিপক্ষ ধর্ম বিশ্বাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন, দেশান্তরিত হচ্ছেন, সর্বহারা হচ্ছেন।
ইরাক ও সিরিয়ার উদ্বাস্তদের সৌদি আরবসহ কোনো মুসলিম দেশ আশ্রয় দিচ্ছে না, আশ্রয় দিচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। যাদেরকে আমরা খ্রিস্টান বলছি। সারা পৃথিবী সব ধর্ম বিশ্বাসীদের ও যারা ধর্ম বিশ্বাস করেন না, তারা যদি নিজেকে না জাগাতে পারেন, তাহলে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সারা পৃথিবীতে ছড়াতে থাকবে। কথায় কথায় তারা, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায় আগুন দিতে থাকবেন। তাদের জানা নেই যারা অন্যকে আগুনে জ্বালাচ্ছেন, পানিতে ডুবাচ্ছেন, একই পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পৃথিবীতে যখন আলোকিত মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ হবে, তখন সব ধর্ম বিশ্বাসীরা একসঙ্গে বলে উঠবেন, প্রভু তুমি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছ। পবিত্র কুরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি তোমাদের সব রগের মধ্যে আছি। যারা নিজেকে চিনতে পেরেছে, তারা নিশ্চয়ই প্রভুর কাছে সমর্পিত হয়েছে। এ ধরনের ব্যক্তিরা চারপাশে শুধু মানুষ দেখতে পান, সেই মানুষের ধর্ম বিশ্বাস দেখতে পান না।
লেখক: কলামিস্ট/সম্পাদনা: আশিক রহমান