মানসিকতার পরিবর্তন ব্যতীত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়
মিল্টন বিশ্বাস
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর পার্বত্য জেলায় এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এর প্রধান কারণ হিসেবে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক নির্বাচন বিধি না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে। পৃথক নির্বাচন বিধি থাকার প্রধান অসুবিধা হচ্ছে এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কেউ ভোটার হতে পারবে না যা সংবিধানের ১২১ ধারা এবং ১২২ ধারার (ভোটার হবার যোগ্যতা) পরিপন্থি। যেখানে দেশের নারী অথবা শিশু অথবা অনগ্রসর শ্রেণির উন্নতির জন্য যেকোনো বিশেষ ধারা সংযোজন অথবা পরিবর্ধন বা পরিমার্জন করা যাবে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং প্রচলিত বিধানের আলোকেই বিধৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, কেবলমাত্র পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত উপজাতিরাই বাংলাদেশে একমাত্র অনগ্রসর জাতি নয়।
উপরন্তু মনে রাখা দরকার, সংবিধানের আলোকে কোনোভাবেই একের অধিক নির্বাচন বিধি থাকার অবকাশ নেই। আমাদের নির্বাচন বিধি দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এটা অত্যন্ত সুখের বিষয় যে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে সরকার ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমানে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের এ সন্ধিক্ষণে একটি জেলা পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা খুবই গুরত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচিত পরিষদ এসে চুক্তির অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জটিলতা দূর করে তা বাস্তবায়নের পথ সুগম করতে পারে। নির্বাচনের আইন প্রণয়ন এবং এর প্রয়োগের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। যেহেতু এই আইন এখনো প্রণীত হয়নি সেহেতু সন্তু লারমার নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। যা আলোচনার মাধ্যমে প্রচলিত রীতির আলোকে হতে পারে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ এবং উপজেলা নির্বাচন ২০১৪ বর্তমান ভোটার তালিকায় এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। অতএব পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচনও উক্ত ভোটার তালিকায় করা সম্ভব। যেহেতু বর্তমান পরিষদ সাময়িক সময়ের জন্য গঠিত সেহেতু তাদের বিভিন্ন কার্যবিভাগ নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেজন্য আমাদের সকলের জন্য অতিসত্ত্বর একটি নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি। জেলা পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে, নির্বাচিত প্রতিনিধি দায়িত্ব গ্রহণ করলে তখন সরকার উক্ত পরিষদের বিস্তৃতি এবং কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন করে ধাপে ধাপে বাকি কার্যবিভাগ হস্তান্তরের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে অতীতের মতো এখনো নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের কারণে তিন পার্বত্য জেলার উপজাতি-বাঙালিদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশি-বিদেশি এনজিও কাজ করে যাচ্ছে সেখানকার জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে। এতে করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর তুলনায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে অনেক বেশি। এমতাবস্থায়, পাহাড়ে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সর্বোপরি শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে উপজাতি-বাঙালি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। সেখানকার বাঙালিদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সন্তু লারমাকেও মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই কেবলমাত্র দ্রুত শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব। রোকেয়া লিটা শুভ্রের মুখ দিয়ে এজন্য বলেছেনÑ ‘পাহাড়ি আর বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় রাঙামাটি আর খাগড়াছড়িতে। সেখানকার পাহাড়ি নেতারা যদিও বলে এখানকার (বান্দরবান) অবস্থা নাকি খুবই নাজুক। কিন্তু আমরা তো দেখি ঘটনা একেবারেই উল্টো। রাঙামাটির নেতারা বলে, বান্দরবানে নাকি পাহাড়িদের মধ্যে নেতৃত্বের সংকট চলছে, তারা আসলে কি ধরনের নেতৃত্বের কথা বলে আমি বুঝি না। সুদক্ষ নেতৃত্ব মানে কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রাম চালানো নয়। সুদক্ষ নেতৃত্ব মানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তবে, নিজেদের অধিকার তো প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, সেটাও হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণভাবে। অপহরণ, চাঁদাবাজি, মানুষ খুন করে নিজেদের অধিকার আদায় করা যায় না।’(পৃ. ৭৭)
লেখক: অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান