নিপীড়িত রোহিঙ্গা : এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?
রবিউল আলম
কিছু দিন যাবৎ ফেসবুক খুললেই বিভৎস ছবি দেখে আতঙ্কিত হই। এসব কি কোনো মানুষের কাজ, এভাবে কি কোনো মানুষ অপর একজন মানুষকে হত্যা করতে পারে, নির্যাতন করতে পারে? ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল আমার, কিন্তু এই নির্যাতনের ধরন দেখে আমার মনে হয়েছে, পাকিস্তানিদেরকেও হার মানিয়েছে। মিয়ানমারে মানুষ বলে কিছু আছে আমার মনে হয় না। আদি যুগের হিংস্র জানোয়ারদেরও হার মানিয়েছে মিয়ানমারবাসী। অপরাধ প্রতিটি রাষ্ট্রেই হয়ে থাকে, অপরাধের বিভিন্ন ধরন আছে, অপরাধীর বিচার আছে, রাষ্ট্রের একটি সংবিধান রয়েছে, জাতিসংঘ আছে, মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে কিনা তা দেখারও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওআইসি এবং আরব দেশসমূহ দাবি করেÑ তারা মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, কুয়েত, আরব আমিরাতসহ সবাই নীরব। কেন?
একবার জেরুজালেমে একটি পটকা ফুটেছিল, এ কারণে ঢাকায় দুইশত গাড়ি পোড়ানো হয়েছিল। মিয়ানমারে হাজারও মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নাম দিয়ে। তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না অত্যাচার নির্যাতন, হত্যা থেকে। এ নিয়ে কোথাও সক্রিয়তা নেই, কোথাও অস্বস্তি নেই, শুধু জাতিসংঘ বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা কারা, কাদের রোহিঙ্গা নাম দিয়ে মিয়ানমার থেকে আলাদা করতে চাইছে? ১৯৪২ সাল থেকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারত- পাকিস্তানের সৈন্যরা তৎকালীন বার্মা বর্তমান মিয়ানমারে যান, কালক্রমে সেখানেই থেকে যান। ১৯৪৭ সাল থেকে কাজের সন্ধানে একের পর এক পরিবার-পরিজন নিয়ে রেঙ্গুন ও আসামে গিয়ে উঠেন। তৎকালীন আসাম ও বার্মায় কৃষি কাজে লোক না থাকায় এই বাঙালিদের কদর ছিল অনেক। জমি নিতে কোনো টাকার প্রয়োজন হতো না। আমার দাদা ১৯৩৭ সালে আসাম যান, সেখানে নিয়ম ছিল, যে যত জমি ফসল ফলাতে পারবে সেই জমির জমিদার পাট্টা দিয়ে দিবেন, আপনি শুধু খাজনা দিবেন আর জমি চাষাবাদ করবেন। দাদা ও তার ভাই, ভাইপো সহ সবাইকে আসাম আসতে উৎসাহিত করলেন। অনেক জমির মালিক ছিলেন তবুও সব ফেলে ১৯৬৩ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল।
জানামতে, একসময় বৃটিশ সাম্রাজ্য ছিল বার্মা, আসাম, কলকাতা। পাকিস্তানে যেতে কোনো পাসপোর্ট ভিসা লাগত না। তাই কাজের সন্ধানে যে কেউ যেকোনো স্থানে আসা যাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না। রেঙ্গুন, ঢাকা, গোহাট্টি, কলকাতার মধ্যে কোনো বাধা-বিপত্তি ছিল না। দেশগুলোর স্বাধীনতা না থাকলেও মানুষের স্বাধীনতা ছিল। সেই স্বাধীনতা থেকেই সাধারণ মানুষ বার্মায় বসবাস শুরু করে। ১৯৪২ সালের জেনারেশন এখন আর বেঁচে নেই। এখন যারা মিয়ানমারে বসবাস করে তারা জন্মসূত্রে মিয়ানমারের নাগরিক। মুসলমান হওয়া কি অপরাধ? যতটুকু জানি, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ অহিংস হয়। এদেশের বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের আমরা অনেক সম্মান দিয়ে থাকি। শান্তিতে নবেল বিজয়ী অন সাং সু চি বিজয়ী হলে মিয়ানমারে ধর্মের কোনো ভেদাভেদ থাকবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস ছিল, তার গৃহবন্দীর প্রতিবাদে বাংলাদেশেও মিছিল হয়েছিল, আজ সেই নেত্রীর মুখ থেকে একটা কথাও বের হচ্ছে না। একদিকে মিয়ানমার, অন্যদিকে তুরস্ক যে কা–কারখানায় মেতে উঠেছে এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে তা কোনো সভ্য মানুষ ও দেশ সমর্থন করতে পারে না। জানি না, আরাকান রাজ্যে শান্তি আসবে কি না। তবে এই অশান্তি ভার পুরো মিয়ানমারকে বহন করতে হবে। সামরিক জান্তা গণতন্ত্র হরণ করে যা করেছে, সেই মাসুল মিয়ানমারের জনগণকে দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে। আশা ছিল গণতন্ত্রের মুক্তির স্বাদ মিয়ানমারের জনগণ ভোগ করতে পারবে, দেশের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা নিবে, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বিরত থাকবে, অং সান সু চির বন্দীত্ব জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ পরিচালনা করবে। আমাদের সকল আশা-আকাঙ্খা গুড়েবালি দিয়ে আজ হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও সর্বসাধারণ। অন্যদিকে তুরস্কও বৌদ্ধ নিধন শুরু করেছে, এই প্রতিহিংসার শেষ কোথায়?
রোহিঙ্গাদের এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগেÑ বিশ্ব সমাজ-সভ্যতার দাবিদাররা আজ কোথায়? পাকিস্তান, ইরান, সৌদি আরবে কি এখন আর মুসলমান নেই, নাকি চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় আওয়াজ বন্ধ? বাংলাদেশের গাড়ি পোড়ালে, মানুষ পোড়ালেও আওয়াজ বন্ধ থাকে না, আর একজন সন্ত্রাসী পুলিশের গুলিতে মারা গেলে মানবাধিকারের দোহাই তুলে দুনিয়া একাকার করে তুলেন। গণতন্ত্রের কথা বলেন, মানুষের অধিকারের কথা বলেন, মানবাধিকারের কথা বলেন, আরও কত কি! কিন্তু মিয়ানমারে অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো কথা নেই, কারও জন্য আশ্রয় নেই, সাহায্য নেই। আমরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম, আমরা জানি অসহায়ত্ব কী। যতটুকু পারি দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে আমাদের। তবে এমন কিছু করা যাবে না যাতে অত্যাচারীরা উৎসাহী হয়। জাতিসংঘের পাশে থেকে মানুষের জন্য কিছু করতে হবে বাংলাদেশকে। অত্যাচারের শিকার মানুষের পাশে সব দেশ, জাতির মানুষ পাশে দাঁড়াবে এটাই প্রত্যাশা। চলমান সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনই এখন দেখতে চায় রোহিঙ্গারা।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
সম্পাদনা: আশিক রহমান