মুদ্রা শুধু বিনিময় মাধ্যম নয়, ক্ষমতারও প্রতীক বটে
হাবিবুর রহমান তাপস
সম্প্রতি ভারত আকস্মিকভাবে তার দেশের ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন শুরু করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বক্তৃতায় বলেছেন, ‘দেশ থেকে কালো টাকা ও জাল নোট উধাও করার জন্য এটুকু ভোগান্তি দেশবাসী সহ্য করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।’ জাল টাকার মোকাবিলায় এই পদক্ষেপ কার্যকরি হবে বলেই সে দেশের অর্থনীতিবিদদের আশা। ভারতীয় গোয়েন্দাদের মতে, পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই এ দেশে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা ঢুকিয়েছে। ভারতের এই ধরনের দাবি একেবারেই অমূলক নয় যখন আমরা জানতে পারি, গতবছর পাকিস্তানি নাগরিক আব্দুল্লাহ সেলিম (৪২) আমাদের দেশে জাল ভারতীয় মুদ্রাসহ র্যাবের কাছে গ্রেফতার হয়। এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের ভিসা কর্মকর্তা মাজহার খানের বিরুদ্ধে জাল মুদ্রার ব্যবসা ও জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয় পরবর্তীতে তাকে বাংলাদেশ থেকে তড়িঘড়ি করে প্রত্যাহার করে নেয় পাকিস্তান। এরপর ফারিনা নামের আরেকজন নারী সেকেন্ড সেক্রেটারি (রাজনৈতিক) পদ মর্যাদার কূটনীতিক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মুদ্রাবাজার ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন বলে আমরা দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি। ভিন্ন পরিচয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতেন। প্রায়ই তাকে দেখা যেত পাকিস্তান দূতাবাসের পার্শ্ববর্তী অভিজাত রেস্টুরেন্ট ও বার ‘ঢাকা ক্যাপিটাল’-এ। শুধু তাই নয়, মাঝরাতে তার দেখা মিলত পুরান ঢাকার বেশকিছু খাবারের দোকানে। সঙ্গীদের থাকত নতুন মুখ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকার একবার পঞ্চাশ ও একশত টাকার নোট বাতিল করেছিল। তাদের অভিযোগ ছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাংকের টাকা লুট করে ভারতে নিয়ে রেখেছে। সেই টাকাগুলো যেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে ব্যবহার না করতে পারে তাই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
আমরা শুধু বাস্তবে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সামরিক শক্তি প্রয়োগ বা যুদ্ধের ঘটনা দেখতে পারি। কিন্তু এছাড়াও রয়েছে কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক লড়াই। এটা আমরা চোখে দেখি না কিন্তু এর দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হই। শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলো একে অন্যের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য তৃতীয় কোনো দেশকে বেছে নিচ্ছে রুট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। যখন প্রায়ই বিপুল পরিমাণ জাল ভারতীয় রুপিসহ পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তখন বুঝতে বাকি থাকে না, পাকিস্তানি গুপ্তচরদের খরচ মেটাতে এবং ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে তারা লিপ্ত রয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশকে তারা রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
একটি দেশের অর্থনীতির মানদ- নির্ভর সে দেশের মুদ্রার মানের উপর। সকল দেশের মুদ্রার মান এক নয়। অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় মুদ্রার মান। বস্তুত টাকার নির্দিষ্ট কোনো রং না থাকলেও অর্থনীতির পরিভাষায় দেশে সাদা ও কালো টাকার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। কোনো দেশে যখন অতিমাত্রায় নকল বা জাল টাকার প্রচলন শুরু হয়, সেখানে খুব দ্রুতই অর্থনীতির মেরুদ- ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ জাল টাকা একটি দেশের অর্থনীতিতে ‘এটম বোমা’র মতো কাজ করে, যা বিস্ফোরিত হলে দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস অবশ্যম্ভাবী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানির পাহাড়ের গুহায় অবস্থিত টাঁকশালে ইহুদি অভিজ্ঞ কারিগর যারা নিখুঁতভাবে টাকা ছাপাতে পারত তাদেরকে বন্দি করে রেখে তাদের মাধ্যমে জাল পাউন্ড ছাপিয়ে তা গুপ্তচর বৃত্তির কাজে লাগানো হতো। একেবারে নিখুঁত জাল নোট দিয়ে বিদেশে গুপ্তচরদের খরচ মেটানো হতো। বাকিগুলো জার্মান অধিকৃত ব্রিটিশ কলোনিগুলোতে ছাড়া হতো। যুদ্ধের শেষদিকে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের এজেন্টগণ জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার মাঝামাঝি এলাকায় এই জাল নোট ছাপানোর টাকশাল আবিষ্কার করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকা প্রচুর কাগজের ডলার ছাপায়। এ কারণে ‘ব্রেটন উড’ সিস্টেম ভেঙে পড়ে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘নিক্সন গুয়াম’ আইল্যান্ড থেকে প্রচারিত এক বক্তৃতায় এই ব্যবস্থা ভেঙে দেন।
যে মুদ্রা নিয়ে এত কাহিনী আমরা কি জানি এর জন্মের ইতিহাস? সর্বপ্রথম মুদ্রা প্রচলনের ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারও কারও মতে, মুদ্রা ব্যবস্থা প্রথম চালু হয়েছিল তুরস্কের লিডিয়ায়। তখন সময়কাল ছিল যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও একহাজার বছর পূর্বে। অন্য আরেকটি মতাদর্শের মানুষ মনে করে চীন দেশেই প্রথম মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। বর্তমানে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যে মুদ্রা ব্যবস্থা প্রচলন আছে সেটি শুধুমাত্র সুপ্রাচীনকালের পণ্য বিনিময় মাধ্যমের বিবর্তনে পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত রূপই নয়, এটি একটি জটিল আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফসল।
সুইডেনের ‘স্টক হোম ব্যাংক’ সর্বপ্রথম কাগজের নোট বাজারে ছাড়ে। ১৮৩৩ সালে আইন করে কাগজের নোটের বৈধতা দেওয়া হয়। ফলে বিশ্বের সকল দেশের জনগণ এই আইন মানতে বাধ্য হয়। অনেকেই হয়তো জানি না, আমাদের দেশের যে টাকাগুলো বর্তমানে প্রচলিত আছে সেটি এক টাকা ও দুই টাকার নোটগুলোতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থসচিবের স্বাক্ষরে বাজারে ছাড়া হয়, এসব আসলে সরকারি মুদ্রা। কিন্তু পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, পাঁচশত, এক হাজার টাকার নোট ছাপে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলো ব্যাংক নোট। যেটি প্রমাণপত্র বা রশিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিবা মাত্রই এর বাহককে দিতে বাধ্য থাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বে প্রবর্তীত গভর্নর।
মুদ্রা শুধু বিনিময় মাধ্যম নয়, ক্ষমতারও প্রতীক বটে। পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করতে কেনা চায়? একদিনের ক্ষমতাসীন বাদশাহ পর্যন্ত নিজ নামে মুদ্রা চালু করে তার নিদর্শন রেখে গেছেন, ইতিহাস সেটি সাক্ষ্য দেয়। টাকা ছাপানো অনেক ব্যয়বহুল। তাই বহুমাত্রিক শক্তিসমৃদ্ধ এই বস্তুটির ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন আবশ্যকীয়। জাপানের সূর্য বংশীয় সম্রাট হিরোহিতুর ছবি টাকার উপর ছাপানো থাকায় একসময় জাপানিরা সেটি খুবই শ্রদ্ধাভরে ও সাবধানে ব্যবহার করত যেন সম্রাটের ছবিটা মলিন না হয়। অথচ আমাদের দেশে রয়েছে এর বিপরীত চিত্র। মনের মানুষ খুঁজতে কিংবা প্রেমপত্র লিখতে টাকাকে অনেকেই বেছে নেন মাধ্যম হিসেবে। যেটি পাহাড় প্রমাণ অজ্ঞতারই প্রমাণ বহন করে। এই মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। মুদ্রা বা টাকা লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ইদানিংকালে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা নগদ টাকা বহনের বিকল্প ব্যাংকিং এটিএম কার্ড প্রচলন হওয়ায় মানুষ নগদ টাকা বহন কমিয়ে দিয়েছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও প্রায় প্রতিটি জেলায় এই প্রথা চালু হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক লক্ষণ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা: আশিক রহমান