যোগ ও যোগী
বিকাশ বিশ্বাস
যোগ যোগÑমনোযোগ। মনস্থির না হলে যোগ হয় না, তা যে পথেই যাও। মানুষের মন চতুর্দ্দিকে নানা বিষয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তা থেকে কুড়িয়ে এনে পরমাত্মাতে মন স্থির করার নাম যোগ। যেখানে হাওয়া নাই, দীপ-শিক্ষা ঠিক সিধে হয়ে জ¦লে, কিন্তু একটু হাওয়া পেলেই শিখা চঞ্চল হয়। তেমনি বাসনার লেশ যদি মনে থাকে, তবেই মন চঞ্চল হবে, সে মনে যোগ সাধন হবে না।
মন যোগীর বশ, যোগী মনের বশে থাকে না। ষোলআনা মন তাঁর জন্য দিলে, তবে তাঁকে পাবে। একটু বিঘœ থাকলে আর যোগ হবার উপায় নাই। টেলিগ্রাফের তারে যদি একটু ফুটো থাকে, তা হলে আর খবর যাবে না।
নিক্তির একদিকে ভার বেশী হলে, উপরের কাঁটা ও নীচের কাঁটার মুখ এক হয় না। উপরের কাঁটা ঈশ্বর, নীচের কাঁটা মানুষের মন। এই দুই কাঁটা এক হওয়ার নামই যোগ। কিন্তু সে রকম একাগ্র মন কয়জনের হয়! কামিনী, কাঞ্চন ও বাসনার ভারে মানুষের মন সংসারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, কাজেই ঈশ্বরের সঙ্গে আর মনের যোগ হয় না। যারা এ ভার তীব্র বৈরাগ্যের জোরে ফেলে দিতে পারে, তাদেরই যোগ হয়। ঠিক দুপুরে ঘড়ির ছোট কাঁটা ও বড় কাঁটা যেমন এক হয়ে যায়,Ñঠিক যোগ হলে সেইরূপে অবস্থা হয়। জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক হয়ে যায়। যোগ চারি প্রকারÑহঠযোগ, কর্ম্মযোগ, জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগ।
শরীরকে আয়ত্তে আনবার জন্য ও শরীর সুস্থ রাখবার জন্য, যে সমস্ত ক্রিয়া করতে হয়, তাকে হঠযোগ বলে। এ যোগে শরীরের উপরেই বেশী মনোযোগ হয়,Ñকিসে দীর্ঘায়ু হবে এই দিকেই নজর যায়, ওতে ঈশ্বরের সঙ্গে বড় সম্বন্ধ থাকে না। কলিতে অন্নগত প্রাণ, অল্প পরমায়ু, এ যুগের পক্ষে হঠযোগ ভাল নয়। অনাসক্ত হয়ে কর্ম্ম করা এবং সেই সঙ্গে ঈশ্বরে সম্পূর্ণ মন রাখার নামই কর্ম্মযোগ। যার ঈশ্বরদর্শন হয়েছে, কেবল সেই অনাসক্ত হয়ে কর্ম করতে পারে। এ যুগের পক্ষে কিন্তু ভারি কঠিন। এ কালে সহজেই আসক্তি এসে পড়ে।
স্ব স্বরূপকে জানা অর্থাৎ ব্রহ্মই আমার স্বরূপÑএই জ্ঞান লাভ করার যে উপায়, তার নাম জ্ঞানযোগ। জ্ঞানের দ্বারা নেতি নেতি বিচার করে এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা যায়। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা, এই বিচার। সৎ অসৎ বিচার। বিচারের শেষ হলেই সমাধি, আর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ। কোনও একটী ভাব অবলম্বন করে ঈশ্বরের সহিত বিশেষ সম্বন্ধ স্থাপন করা এবং তাঁর নামগুণ কীর্ত্তন করে তাঁতে মন রাখার নাম ভক্তিযোগ। রাজযোগ মনের দ্বারা যোগ, বিচারের দ্বারা যোগ, ইহা ভক্তিযোগেরই মধ্যে।
ধ্যান করবেÑমনে, কোণে, বনে। মনকে একাগ্র করবার জন্য, ধ্যান করবার আগে খানিকক্ষণ হাততালি দিয়ে ‘হরিবোল’ বোলবে। গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে গাছের সব পাখী উড়ে যায়, সেই রকম ধ্যানের আগে হাততালি দিয়ে হরিনাম করলে, মনের কু-চিন্তা, বিষয়-বাসনা ইত্যাদি চলে যায়। ধ্যান করবার সময় তাঁতে মগ্ন হতে হয়।
উপর উপর ভাসলে জলের নীচের রতœ পাওয়া যায় না। গভীর ধ্যান হলে বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়। ঠিক ধ্যান যে হচ্ছে তার একটা লক্ষণ এই যে, মাথায় পাখী বসবে জড় মনে ক’রে। চক্ষু চেয়েও ধ্যান হয়, কথা কচ্চে তবু ধ্যান হয়। যেমন একজনের যদি দাঁতের ব্যামো থাকে, সে সব কর্ম্ম করছে, কিন্তু সেই দরদের দিকে মনটা রয়েছে। পাখী যখন ডিমে তা দেয়, তখন তার সব মনটা ডিমের উপরে, বাহ্যিক চেয়ে থাকে মাত্র।
যোগীর চক্ষুও ঐ রকম ফ্যাল্?ফেলে, বাইরের জিনিসে তাদের বড় নজর নাই। সর্ব্বদাই আত্মস্থÑসর্ব্বক্ষণ তাদের মন ঈশ্বরেতে। ঈশ্বর আমার হৃদয়-মধ্যে আছেন, সর্ব্বদাই এই চিন্তা করবে। এইরূপ করতে করতে ঠিক তাই দেখতে পাবে। অভ্যাস করলে একই মন দ্বারা সংসারের কাজও করা যায়, আবার ঈশ্বর-সাধনও হয়।
ঘোড়ায় চড়া বড় কঠিন, কিন্তু যারা অভ্যাস করে, তারা অনায়াসে তার উপরে নৃত্য করে থাকে, তাকে নিয়ে কত খেলা করেÑযেমন সার্কাসে করে থাক। যোগী দুইরকম। ব্যক্ত যোগী, আর গুপ্ত যোগী। যারা সর্ব্বস্ব ত্যাগ ক’রে ঈশ্বরচিন্তা করে, তারা ব্যক্ত যোগী। আর যারা সংসারে আছে, কিন্তু মনে সর্ব্বস্ব ত্যাগ করেছে, তারা গুপ্ত যোগী।
যোগীকে ধৈর্য্যরেতা হ’তে হয়। দ্বাদশ বৎসর ধৈর্য্যরেতা থাকলে, তাকে ‘ঊর্দ্ধরেতা’ বলে। ঊর্দ্ধরেতা হলে তবে মেধানাড়ী জন্মে। তখন জ্ঞান লাভ করবার ও ধ্যান করবার যোগ্যতা হয়। হাজার বৎসর রেত ধারণের পর যদি একদিন স্বপ্নেও তাহা স্খলন হয়, তা হলে সমুদয় যোগ ভ্রষ্ট হয়ে যায়।