ধর্মের নামে…
সৈয়দ রশিদ আলম
ফরিদপুর, বিশিষ্ট এক পীর সাহেবের দরবার শরিফ, দুজন বন্ধু সেই পীরের সাক্ষাতের জন্য গেলাম, গিয়ে দেখলাম বিশাল আকৃতির সেই পীর সাহেব খালি গায়ে শুয়ে আছেন, দুজন স্বাস্থ্যবান রমণী সেই পীর সাহেবের শরীর ম্যাসেজ করছেন। জানতে চাইলাম কি হচ্ছে, একজন মুরিদ উত্তর দিলেন, এই মুহূর্তে আমার পীর চূড়ান্ত সাধনার স্তরে আছেন, তার দেহটা শুধু পড়ে আছে, আত্মাটা অদৃশ্যলোকে পাড়ি জমিয়েছে। কলকাতা, বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন একটি মন্দির, কয়েকশ নারী-পুরুষ আপেল, কমলা, আঙ্গুর এনে পুরোহিতের সামনে রাখছেন আর সেই পুরোহিত সবাইকে আশীর্বাদ করছেন। একটি পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম, সবাই চলে যাওয়ার পর সেই ফলগুলো ভাগাভাগি হচ্ছে।
বান্দরবান, বহুল পরিচিত একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা, গৌতম বৌদ্ধের অনুসারীরা বিভিন্ন ফুল ও নানা ধরনের দামি ফল, বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছে জমা দিচ্ছে, তিনি সবাইকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন, ভক্তরা চোখের পানি ফেলে গৌতম বৌদ্ধের মূর্তির সামনে অশ্রুবর্ষণ করছেন, কিন্তু যে ফলগুলো ভক্তরা প্যাগোডায় রেখে গেলেন সেই ফলগুলো সেই ভিক্ষু ও তার অনুসারীরা খাওয়া শুরু করে দিলেন। মিরপুরের একটি বিখ্যাত মাজার, এক ভদ্র মহিলা তার মেয়ের ঘরে সন্তান হওয়ার খুশিতে সেই মাজারে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত হলেন, উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গরিব মানুষগুলো মিষ্টিগুলো খাবেন কিন্তু মিষ্টির প্যাকেটগুলো শেষ পর্যন্ত খাদেমদের হাতে চলে গেল, তারপর সেই মিষ্টিগুলো চোখের পলকে খাদেমদের পেটে। অসহায় গরিব মানুষগুলো খাদেমদের মিষ্টি খাওয়া দেখলেন মলিন বদনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ঢাকার বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন একজন পীর সাহেবের দরবার শরিফ, শতশত লোক সেই দরবার শরিফের পীর সাহেবের সাক্ষাতের জন্য এসেছেন। সাক্ষাৎ প্রার্থীরা লাইনে দাঁড়িয়ে পীর সাহেবের কাছে যাচ্ছেন, খালি হাতে যাচ্ছেন না, সঙ্গে নিতে হচ্ছে এক হাজার এক টাকা মাত্র! এই টাকা পীর সাহেবের হাদিয়া। এই পীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ যদি করতে চান হাদিয়া ছাড়া কোনোভাবেই সাক্ষাৎ পাবেন না। অর্থাৎ পৃথিবীর সব ধর্ম বিশ্বাসীদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যেক ধর্ম বিশ্বাসীরা ছোট ছোট দোকান খুলে বসেছেন। আর এই দোকানে যারা যাচ্ছেন, যাদের কাছে যাচ্ছেন তারা জানেন না তিনি শুধুই একজন দোকানদার, যিনি ধর্মের নামে দোকান খুলে বসেছেন। অসহায় মানুষগুলো যখন সর্বহারা হয়ে পড়ে চারপাশে অন্ধকার দেখতে পায়, তখন তাদেরকে আলো দেখানোর মতো তারা কাউকে খুঁজে পায় না। কিন্তু যাকে খুঁজে পায়, দেখা যায় তিনি একজন ধর্ম ব্যবসায়ী।
ধর্ম কোনো ব্যবসার জন্য তৈরি হয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই ধর্মকে সারা পৃথিবীতে বাণিজ্যিককরণ করা হয়েছে, যার ফলে আপনি যে ধর্ম বিশ্বাসী হন না কেন, যেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যান না কেন, গিয়ে দেখবেন একদল দানবের দখলে সেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চলে গেছে। আর যারা সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত ধর্মীয় মানুষ কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই তাদের স্থান হচ্ছে না। পৃথিবীর কোনো ধর্ম বিশ্বাসীরা আর সৎ কর্মশীলদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না, যাদের প্রতি আস্থা রাখছেন, সেখানেই গিয়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। কারণ একটাই সীমাহীন লোভী মানুষগুলোকে, ভোগী মানুষগুলোর হাতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে।
যারা সৎ উপায়ে অর্থ উপার্জনে বিশ্বাস করেন, তারা কোনো জায়গাতে স্থান পাচ্ছেন না। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই, সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষকে শুধু ধর্মের জন্য জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু যারা দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছেন, এক ধর্ম বিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আরেক ধর্ম বিশ্বাসীদের মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছেন। প্রত্যেক ধর্ম বিশ্বাসী যদি মনোযোগ দিয়ে নিজের ধর্মগ্রন্থ যদি পাঠ করেন, আলোকপ্রাপ্ত মানুষের জীবনী পাঠ করেন, তাহলে ধর্মের নামে যারা দোকান খুলে বসেছেন তাদের দ্বারা তারা কখনোই প্রতারিত হবেন না।
লেখক: কলামিস্ট
সম্পাদনা: আশিক রহমান