কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দুর্নীতিতে দুদকের দেড় শতাধিক কর্মকর্তা
বিপ্লব বিশ্বাস: দুর্নীতিকে জাদুঘরে পাঠানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করার প্রায় এক যুগ অতিক্রম করার পরও নিজ ঘরের জঞ্জাল সাফে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ব্যস্তসময় পার করতে হচ্ছে। ফলে দেশের বিভিন্ন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে দুদকের অনেক নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাকে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমনে বেশি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।
দুদকের কিছু কর্মকর্তা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণে একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহায়তায় দেশের বড় দুর্নীতিবাজরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘সব অর্জনই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতির কারণে। মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না যে, দুদক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে। আমরা সেই রকম কাজ করতে পারিনি বলেই এই বিশ্বাসহীনতা, এটা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই, এটাই সত্য।’
অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, অভিযুক্তকে অব্যাহতি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অর্থ আদায়, প্রকৃত অপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যক্তিকে চার্জশিটভুক্ত করা, ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করা, চেক জালিয়াতি, অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম, দুদকের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে গ্রেফতারসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে অন্তত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে। এরই মধ্যে কিছু কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে বা কাউকে পদ-অবনমন করা হয়েছে। অনিয়ম, দুর্নীতি, অসদাচরণের দায়ে বিগত ৬ থেকে ৭ বছরে দুদক দেড় শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। বর্তমানে ১৫ জনের বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। আর প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। অতি সম্প্রতি দুদকের অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতিতে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন প্রতিরোধ ও গণসচেতনতা বিভাগের উপপরিচালক সামিউল মাসুদ ও প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক মঈনুল হাসান রওশনী।
অভিযোগ রয়েছে, বিগত দিনে প্রশাসন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতিসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করেছেন। এসব অনিয়ম, দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ অফিশিয়াল নথিপত্রে রয়েছে। এই অবৈধ কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। এর মধ্যে সদ্য অবসরে যাওয়া দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মো. শহিদুজ্জামানেরও নাম রয়েছে।
অনুসন্ধান চলছে দুদকের চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক সৈয়দ আহমেদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ঠিকাদারের যোগসাজশে ভুয়া বিল ভাউচার, মাস্টাররোল ও কোটেশনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিআরপিএআর প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে কোটি টাকা উৎকোচ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দুদক পরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসেন ওই অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন। ভয় দেখিয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নির্মাণ সমাগ্রী নিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক রইস উদ্দিনের বিরুদ্ধে চলছে আরও একটি অভিযোগ। দুদক উপপরিচালক মো. মফিদুল ইসলাম ওই অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন।
দুর্নীতির দায়ে এর আগে উপপরিচালক শফিকুল ইসলামকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে উপপরিচালক আহসান আলীকে। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা ও জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সহকারী পরিদর্শক হাফিজুল ইসলামকে অসদাচরণ ও দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত করা হয় উপপরিচালক ঢালি আবদুস সামাদকে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে উপপরিচালক রামমোহন নাথ, উপপরিচালক এস এম শাহিদুর রহমান ও কোর্ট সহকারী ওবায়দুল্লাহ খালেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ছয় কর্মচারীকে। তারা হলেন- সহকারী পরিচালক সাঈফ মাহমুদ, সহকারী পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান, কনস্টেবল জামিল মোহাম্মদ খান ও ফারুক আহমেদ। দুর্নীতির দায়ে চাকরি থেকে অপসারিত নয় কর্মচারী হলেন ডাটা এন্ট্রি/কন্ট্রোল অপারেটর আবদুর রহমান, কনস্টেবল ফরহাদ হোসেন, এস এম গোলাম কিবরিয়া, আবু বকর সিদ্দিক, আবদুল মোতালিব মিয়া, গোলাম রব্বানী, আলমগীর হোসেন, অমিত কুমার দাস ও গাড়িচালক গোলজার হোসেন ভূঁইয়া।
দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে বলেন, ‘দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মনিটরিং ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিন্দুমাত্র অনুকম্পা দেখানো হবে না।’ সম্পাদনা : শাহানুজ্জামান টিটু