একান্ত সাক্ষাৎকারে পি. আর বড়–য়া ‘বর্বরোচিত হত্যাকা- চালিয়েছে মিয়ানমার, ওরা বৌদ্ধ ধর্মের কলঙ্ক’
মুরাদ হাসান ও ফারুক আলম: মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বরোচিত হত্যাকা- চালিয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী, সীমান্ত পুলিশ এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ডিআইজি (অব.) পি. আর. বড়–য়া দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেয়া বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অমানবিক।
তিনি বলেন, আমরা এক সময় মিয়ানমারের বৌদ্ধদের ভাল জানতাম। এখন তারা যে ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে এর নিন্দা করা ছাড়া আমাদের কোনো ভাষা নেই। এরপরেও আমরা রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন ও বিতাড়ণ বন্ধে ১৫ দিন ধরে কাজ করছি। প্রেস কনফারেন্স করেছি। রোহিঙ্গারাও মানুষ, তাদের ওপর নির্যাতন চালানো উচিত নয়।
বৌদ্ধ শান্তিপ্রিয় ধর্ম একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ ও ‘জীব হত্যা মহাপাপ’, নীতিকথাগুলো বলেছেন গৌতম বুদ্ধ। মানবতাবাদী হিসেবে জগৎসংসারে তিনি প্রতীক হয়ে আছেন। প্রবর্তন করেছেন বৌদ্ধ ধর্মের। গৌতম বুদ্ধ আরো বলেছেন, আমার এই ধর্ম শুধু বৌদ্ধদের জন্য নয়, পৃথিবীতে সব ধর্ম-বর্ণের জন্য। আর সেখানে মিয়ানমার সরকার ও সেখানকার জনগণ রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। অর্থাৎ মিয়ানমারের বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্মের কলঙ্ক। এটি আমার কথা নয়, সব বৌদ্ধের কথা। আমি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেখানে যাই সেখানেই বলার চেষ্টা করি, মিয়ানমারের বৌদ্ধরা বৌদ্ধ ধর্মের কলঙ্ক। তারা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
রোহিঙ্গারা কোথা থেকে রাখাইন প্রদেশে এসেছে এ বিষয়ে পি. আর. বড়–য়া বলেন, ১৯৩৩ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসল আমলে মিয়ানমার দিল্লি থেকে শাসিত হত। তখন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও নোয়াখালী অঞ্চলের কিছু লোক বাণিজ্যিক কাজে বার্মায় (মিয়ানমার) যেত। বাণিজ্যিক কাজ শেষে অনেকে দেশে (বাংলাদেশ) ফিরে আসে আবার অনেকে বার্মায় স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে। ওই সময়ের ব্রিটিশ সরকার রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা বার্মায় থাকবে নাকি ভারতে যাবে। তখন রোহিঙ্গারা বলেছে, তারা বৌদ্ধদের সঙ্গে থাকবে, হিন্দুদের সঙ্গে নয়। এরপর যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল তখন বৌদ্ধরা জাপানিদের সমর্থন করে আর রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের সমর্থন করে। মূলত সেখান থেকেই বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে মতবিরোধের সৃষ্টি। মতবিরোধ থাকতেই পারে, কেউ কারও ওপর নির্যাতন চলাতে পারে না।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা প্রশংসনীয়। যেসব রোহিঙ্গা এদেশে এসেছে মানবিক কারণে তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে একশ বছর ধরে বসবাস করছে, তাদেরকে কেন তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে? মিয়ানমার সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে অচিরেই যেন তাদেরকে দেশে ফিরে নেয়ার ব্যবস্থা করে।
তিনি আরও বলেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের ভেতর কে কী বলছে তা জানি না, আমরা শুধু তাকিয়ে আছি অং সান সুচির দিকে। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম সরকার। তার নির্দেশেই সব কিছু চলে। শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। তিনি অন্তত এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। তাকে বিনীত অনুরোধ করছি, শান্তির দূত আপনি, হাত বাড়ান।
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী নিরাপত্তার নামে ভিক্ষুদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে পি. আর. বড়–য়া বলেন, এ বিষয়টি এখন অস্বীকার করবো। প্রথম দিকে ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করেছে। কিন্তু এখন হচ্ছে কি জানেন? মিডিয়া অন্য জায়গার কিছু ঘটনা এখানে এনে প্রচার করছে। এক সময় তিব্বতে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেছে। সেই ছবিগুলো এখন মিডিয়াতে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলায় প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকের নাম নিয়ে তিনি বলেন, কয়েকদিন আগে পত্রিকাটিতে কিছু ছবি ছাপানো হয়েছে। সেখানে তারা জানেনই না এই ছবিগুলো কোথাকার। না জেনে ছবি ছাপানো ঠিক নয়, এতে জনগণকে মিস গাইড করা হচ্ছে। এই বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছি। তবে এটা সত্য, মিয়ানমারে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেখানে বর্ডার গার্ডের ৯ সদস্যকে হত্যার সূত্র ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এখানে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে পুরো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো অমানবিক ও বেআইনি কাজ।
পি. আর. বড়–য়া বলেন, মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে আমরা যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রয়েছি তাদের তো কোনো অপরাধ নেই। বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই একসঙ্গে বসবাস করছি। এদেশের মানুষ এখন যদি রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে আমাদেরকে (বৌদ্ধ) ভিন্ন চোখে দেখেন তাহলে সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছি, এদেশে যতগুলো বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে কোথাও যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। বাংলাদেশের বৌদ্ধরা কোনো অপরাধ করেনি। এরপরেও গ্রামগঞ্জের কিছু খারাপ প্রকৃতির লোকজন সুযোগ পেলেই বৌদ্ধদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। এজন্য আমরা কক্সবাজার, টেকনাফ, বগুড়াসহ দেশের যেসব এলাকায় বৌদ্ধ রয়েছে তাদেরকে সান্ত¡না দেবো। এমনকি স্থানীয় নেতা, এমপি ও ডিসি-এসপিদের সঙ্গে দেখা করবো।
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন বারবার বিবৃতি দিলেও এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এ ব্যাপারে অবশ্যই জাতিসংঘকে উদ্যোগ নিতে হবে। পি. আর. বড়–য়া নিজের ধারণার কথা তুলে ধরে বলেন, মিয়ানমার সরকার জাতিসংঘ ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রের কথা শুনবে বলে মনে হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা ভোটাধিকার নেই। বর্তমানে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সমাধান হচ্ছে, যারা বাংলাদেশে এসেছে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে বাসস্থান ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা। জোর করে মিয়ানমারে পাঠানো ঠিক হবে না। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকারসহ সব সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান আলোচনা ছাড়া সম্ভব নয়।
রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে মিডিয়া সদস্যরা মিয়ানমারে যেতে চাইলে বাধা দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যেকোনো কৌশলে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে। সেখানে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আছে। সবাই যদি বাংলাদেশে আসে সেটি আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাদেরকে চাকরি দেব কোথায়, খাওয়াবো কিভাবে, চিকিৎসা দেব কিভাবে? আমরা নিজেদের নিয়েই সমস্যায় আছি।
পি. আর. বড়–য়া আরো বলেন, মিয়ানমার সরকারের পলিসি রোহিঙ্গারা তাদের দেশের (মিয়ানমার) লোক নয়, এরা বহিরাগত। রোহিঙ্গা বিতাড়ণের ক্ষেত্রে এ ইস্যুটি বড় হয়েছে। দেশভাগের সময় বাংলাদেশে থাকা বৌদ্ধদের মিয়ানমার সরকার বলেছিল, তোমরা মিয়ানমারে চলে এসো, আমরা যাইনি। এ দেশ (বাংলাদেশ) আমাদের, এখানে খেতে পেলেও থাকবো, খেতে না পেলেও থাকবো। সম্পাদনা : মাহমুদুল আলম