গণধর্ষণ-হত্যা-শিশুহত্যা-লুটপাট মধ্যযুগের বর্বরতাকেও ছাড়িয়েছে মিয়ানমার
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: মিয়ানমারে গত ২০ দিন ধরে চলা গণধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট ও শিশুহত্যা মধ্যযুগের সব বর্বরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ২৯টি পাড়া আক্রমণ করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। আর ধর্ষিত হয়েছেন ৩ থেকে ৪ হাজারের বেশি কন্যাশিশু ও নারী। সহস্রাধিক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে সীমান্ত এলাকা দিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরাণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এবং সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক নেতার কাছ থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
তথ্য মতে, গত ৯ নভেম্বর থেকে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের ২৯টি পাড়ায় হামলা চালিয়েছে। এরমধ্যে একটু অবস্থা সম্পন্ন রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর সোনাদানা টাকাকড়ি সবই লুট করেছে। গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু-পাখি নিয়ে গেছে এবং বাড়ির পুরুষ লোকদের গুলি করে হত্যা করেছে। এ পর্যন্ত গ্রেফতার করেছে ২ হাজারেরও বেশি পুরুষকে। আর গুলি করা হত্যা করেছে দেড় হাজারের বেশি সাধারণ মানুষকে। এরমধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। গুলি খেয়ে নিহত শিশুর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি । ধর্ষিতা হয়ে এবং গুলি খেয়ে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক নারী। এরমধ্যে রয়েছে ৯ বছরের কন্যাশিশু থেকে শুরু করে ৫০ বছরের নারী।
মংডুতে বসবাসকারী নুরুল ইসলাম গতকাল এই প্রতিবেদককে জানান, প্রথমে সেনারা একটি পাড়াকে টার্গেট করে। তারপর সবদিক থেকে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা ঘিরে ফেলে। গুলি করতে করতে এগোতে থাকে। এ সময় পুরুষ পেলেই গুলি করছে। তারপর সব নারী বিশেষ করে তরুণী এবং কন্যাশিশুদের একটি জায়গায় জড়ো করে আনা হয় এবং তাদের জোর করে বিবস্ত্র করে রাইফেল তাক করে রাখা হয়। জীবনের ভয়ে এসব মেয়েরা বাবা-স্বামী-সন্তান-ভাই বা অন্যসব আত্মীয়-স্বজনের সামনে বিবস্ত্র হতে বাধ্য হন। তারপর চলে আরও বিভৎস ঘটনা। সেনারা গাছের সঙ্গে না হয় বিছানায় বেঁধে এসব তরুণীর উপর গণধর্ষণ চালায়। এই সময় আর্তনাদে আর বাঁচাও চিৎকার শোনা যায়। কিন্তু কারও পক্ষেই প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না। একটু দেখতে সুন্দর মেয়েদের তুলে নিয়ে যায় মিয়ানমার সেনারা।
ওপারের কেয়ারিপাড়া থেকে আসা মিনারা (১৮) টেকনাফের কুতুপালং ক্যাম্পে উঠেছেন। হাঁটতে পারছেন না। মিনারা মাথা নিচু করে বলেন, তিনিসহ কেয়ারিপাড়ায় শেষ হামলার দিন ২৫-৩০ জন নারীকে বিবস্ত্র করে উল্লাস করেছে সেনারা। তারপর সবার সামনেই চলে গণধর্ষণ। মিনারা বলেন, তাকে কতজন ধর্ষণ করেছেন শেষ পর্যন্ত তিনি বলতে পারবেন না। অজ্ঞান হয়ে যান। এ দৃশ্য দেখে তার মা ও ছোট দুই ভাইবোন চিৎকার করে উঠলে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এর প্রায় ৬ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে মিনারা দেখেন, তার বাবা আলী নূর, মা, ছোট দুই ভাই-বোনের লাশ পড়ে আছে। অন্য ধর্ষিতাদেরও একই অবস্থা। চারদিন বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকার পর গত মঙ্গলবার হ্নীলা দিয়ে রাতে মিনারাদের একটি দল বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
জানা গেছে, গতকাল সর্বশেষ দক্ষিণ মংডুর বোরা শিকদারপাড়ায় তৃতীয়বারের মতো হামলা হয়। এর আগে বলা হয়েছিল, দ্রুত সবাই যেন পাড়া ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তারপরও কয়েকটি পরিবার সুযোগ না পেয়ে কোথাও যেতে পারেনি। ফলে গতকাল সকালে এসে ৯টি অবস্থাসম্পন্ন বাড়িতে আগুন দেয়। আর গণধর্ষণের শিকার হন ২০ নারী। এরমধ্যে ১২ জনের নাম জানা গেছে। রয়েছে ১৩ বছর বয়সী নূর বেগম, ১১ বছরের আলমাস খাতুন। এদিকে এর আগের হামলার পর পাড়াটি ছিল প্রায় পুরুষশূন্য। তারপরও যারা ছিলেন কেউই বাঁচতে পারেননি।
এদিকে অসমর্থিত বেশ কয়েকটি সূত্রের হিসাব থেকে দেখা যায়, ধর্ষিতা হয়েছেন এরকম ৬ শতাধিক নারী টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। তাদের বেশির ভাগই অসুস্থ। আমাদের অর্থনীতির অনুসন্ধানে রয়েছে ৩২৪ জন ধর্ষিতার নাম। যারা প্রায় প্রত্যেকেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, যেভাবে নারী ও শিশুদের উপর অত্যাচার চলছে, তা মধ্যযুগের সব বর্বরতাকে ছাড়িয়ে গেছে। এই গণহত্যার জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ আমরা যে মানবিক তা অনেকবার প্রমাণ করেছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কক্সবাজার জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ করতে হবে, মিয়ানমারের এই গণহত্যার বিরুদ্ধে। একটি দেশ বছরের পর বছর গণহত্যা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষ খুন করবে এবং তাড়ানোর জন্য নির্বিচারে গুলি চালাবে, আর আমরা সেই দায় নেব। এটা তো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অবিচার আমাদের প্রতি। জেলা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, এখন আমাদের বিচার চাওয়ার সময় এসেছে। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্বকে দাঁড়াতে হবে। সম্পাদনা: মাহমুদুল আলম