শহীদ মিনারে কমেডি-শো না করে বরং মেধার খোঁজ করুন : যায়নুদ্দিন সানী
সম্প্রতি শহীদ মিনারে হয়ে গেল একটা কমেডি-শো। ঘ্যান ঘ্যান এবং প্যান প্যান করে যা বলা হলা তার সারাংশ হচ্ছেÑ বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়াল তাদের পেটে লাথি মেরেছে। সোÑ এসব বন্ধ করতে হবে। গ্রেট। একটা কথা ভেবে দেখেছেন? কাল যদি অন্য একটি ভারতীয় চ্যানেল, একই কাজ শুরু করে? তখন কী করবেন? ভারতে গিয়ে আন্দোলন করবেন? ইউটিউবে প্রচার শুরু করলে? ডিভিডি বিক্রি শুরু করলে? আচ্ছা, আপনারা কি ইতিহাস পড়েন না? রবীন্দ্রনাথ পড়া ঠেকানো গেছিল? কেন যায়নি? কারণ মানুষ কোনো কিছু পছন্দ করলে সে সেটা দেখবেই। এভাবে নিয়মকানুন বানিয়ে কি কোনোকালে কোনো কিছু আটকানো গেছে? না যাবে? এ নিওয়ে, আপনাদের নিরুৎসাহিত করছি না, ক্যারি অন। দেখা যাক বাঙালি আপনাদের এ আন্দোলনের কী উত্তর দেয়।
আমি জানি, ঘিয়ের ভা-টা ভস্মেই ঢালছি। তারপরও, বাঙালি তো, একটা জিনিসই বিনে পয়সায় বিতরণ করি, ‘উপদেশ’। উপদেশ শুনতে হবে এমন কোনো কথা নেই, মানার বাধ্যবাধকতা তো নেইই। তাই বাকি লেখাটা পড়া জরুরি নয়। আপনাদের জন্য এখানেই সারাংশটা লিখে দিচ্ছি, যা করছেন তাতে পাবলিক হাসছে আর বলছে, ‘নিজেদের মুরোদ নেই ভালো কিছু বানাবার, পারিস শুধু বাগড়া বাধাতে।’ কিছু তাত্ত্বিক আঁতেল আবার অন্য লাইন ধরেছে, ‘জুতা পরে শহীদ মিনারে ওঠা’Ñ এসব টপিক এনে বিরোধিতা। আমি তা করছি না। সোজাসুজিই বিরোধিতা করছি। কারণ এটা সমাধান না। যেহেতু ঘিলু আপনাদের মাথায় কখনই ছিল না এবং নেহাত অঘটন না ঘটলে সেটা গজাবার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না, সো, আপনাদের বুঝিয়ে লাভ নেই।
বিটিভির জামানা এখন আর নেই। একসেপ্ট দ্য ফ্যাক্ট। আমরা আকাশ সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছি আর সেখানে টিকে থাকার একটাই ফর্মুলা, দর্শক টানুন। কীভাবে টানবেন, সেটা ভাবুন। সিরিয়াল দিয়ে পারলেÑ সিরিয়াল, খেলা দিয়ে পারলেÑ খেলা, টক শো দিয়ে পারলেÑ টক শো। নো আদার অপশান। ‘ও আমার দর্শক কেড়ে নিল’Ñ মার্কা নাকিকান্না কেঁদে লাভ নেই। আপনি একাই কাঁদবেন, একাই শুনবেন। দর্শকের সময় নেই আপনার দুঃখের গল্প শোনার। আপনি এবং আপনাদের মতো গবেটরা যখন দর্শক কেন ‘জি বাংলা’ দেখছে বলে কাঁদছিলেন, ‘দীপ্ত’ তখন নতুন কিছু ভেবেছে। দর্শকের চোখ দেশি চ্যানেলের দিকে ফেরাতে হবে।
নিজেদের মুরোদ নেই, স্বীকার করেই নিয়ে এসেছে ডাবিং করা সিরিয়াল। তাতে তারা আপাতত বাজিমাত করে দেখিয়েছে। ‘সুলতান সুলেমান’ শুধু হিট না এখন এটা একটা ট্রেন্ড সেটার। একে একে অনেকে ঝুঁকছে বিভিন্ন হিট সিরিয়ালকে ডাবিং করে নিয়ে আসতে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? সোজা উত্তর হচ্ছে, দর্শক দেখছে, তাই। তবে উত্তরটাকে আরেকটু বিস্তৃত করলে বেরিয়ে আসবে আরও রূঢ় সত্য। আমি ব্যবসা করতে চ্যানেল খুলেছি। দেশের আর্টিস্টদের ভাত খাওয়াতে গিয়ে আমি লস গুনব কেন? অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট। দর্শক টানে এমন কাজ দিন। সিরিয়ালে আটকে থাকতে হবে কেন?
ডাবিং করা সিরিয়াল আপনাদের ভাত মারছে, আই এগ্রি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন এই সিরিয়ালগুলো আসলে কী করেছে? প্রথম যে কাজটি করেছে তা হচ্ছে যে চোখগুলো পুরোপুরি ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের দিকে ঘুরে গিয়েছিল, সেগুলোকে ফিরিয়ে এনেছে। ইজন্ট দ্যাট গ্রেট? যা আপনারা এতদিন পারেননি তা এই সুলতান সুলেমান করে দেখিয়েছে। হিংসে হচ্ছে? না কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছেন? মাথায় ঘিলু থাকলে, সমাধান দেখতে পেতেন। ‘সুলতান সুলেমান’ যে সমাধানটা আপনাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, তা হচ্ছেÑ ‘কোয়ালিটি’।
‘বাজেট নাই’-মার্কা বাহানা দিয়ে কতদিন চালাবেন? ভালো কিছু বানান, দর্শকের চোখ ফিরবে। কীভাবে বানাবেন, কে টাকা দেবেÑ এসব নিয়ে নাকিকান্না না কেঁদে এর সমাধান নিয়ে ভাবেন। কীভাবে কম খরচে নাটক বানানো যায়, সেই সমাধান আপনাকেই বের করতে হবে। দরকার হলে এ নিয়ে ব্রেন স্টরমিং করেন। বাট, ‘সুলতান সুলেমান’কে আটকে আপনার বস্তাপচা নাটক গেলাতে যাবেন না। পাবলিক খাবে না, বরং আবার ‘জি বাংলা’র কাছে ফিরে যাবে।
এখন কি বুঝতে পারছেন, কেন আপনাদের গবেট বলছি? কোথায় ‘সুলতান সুলেমান’কে থ্যাঙ্কু দিবেন, তা না করে আন্দোলন শুরু করেছেন। ‘সুলতান সুলেমান’ চিৎকার করে করে আপনাদের শোনাচ্ছে, ‘জি বাংলা’ থেকে দর্শকদের চোখ ফিরিয়ে আনার সমাধান খুব সোজা। ওখানকার নাটক এমন আহামরি কিছু না। ভালো কিছু পাই না, তাই দেখি। ওদের চেয়ে ভালো নাটক বানান, আমরা আবার দেশি চ্যানেল দেখব।
এবার একটু অন্য গল্প বলি। অ্যাজ, যে সমস্যা আপনারা ফেস করছেন, বছর বিশেক আগে একই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল ভারতও। সেখানেও গবেট আছে। প্রথম প্রথম যখন হলিউডি সিনেমা ডাব করে সিনেমা হলে দেখানো শুরু করেছিল, আপনাদের মতো তারাও নাকিকান্না শুরু করেছিল, ‘হলিউডি ছবি ডাব করে সিনেমা হলে দেখানো যাবে না।’ ধোপে টেকেনি। তবে সেই সমস্যার অন্য সমাধান তারা বের করেছে। সিনেমার বাজেট বাড়িয়েছে। প্রচারণার জন্য বাজেট বাড়িয়েছে। বিভিন্ন স্টাইলে প্রচার করছে। গসিপ ছড়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন রিয়েলিটি শোÑ হেন সুযোগ নাই যা ব্যবহার হচ্ছে না। হলিউড থেকেই হয়তো শিখেছে, তবে শিখেছে। পশ্চিমা দেশ থেকে ‘কোন বানেগা ক্রোড়পতি’ ‘বিগ বস’ এমন সব আইডিয়াও যেমন চুরি করেছে তেমনি কমেডি শো আমদানিও করেছে। সিরিয়াল ছাড়া আর কিছু ভাবা যাবে না, এমন চিন্তায় তারা থমকে থাকেনি। ওদের ফর্মুলাই কপি করতে হবে, তা বলছি না, বলছি, সিরিয়ালই সব না। ভাবুন, নতুনত্ব আনুন।
পরিশেষে বলব, ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের আগ্রাসনে পর্যুদস্ত বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোর ভেতর থেকে একটিমাত্র চ্যানেল সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশের দর্শকদের চোখ ঘুরিয়ে দিতে। কেন ঘুরেছে, তা নিয়ে ভাবুন। এই ঘুরে যাওয়াকে ধরে রাখতে সচেষ্ট হোন। পরিচিত ধনকুবেরদের কাছে যান, বলুন নাটকে ইনভেস্ট করতে। সরকারকে বলুন টিভি নাটকের জন্য বড় একটা স্টুডিও বানাতে। চ্যানেলের মালিকগুলোকে অনুরোধ করুন, বিজ্ঞাপন কমাতে। সবাই এক প্ল্যাটফর্মে যখন এসেছেন, তখন সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিন। জি বাংলার চেয়ে ভালো সিরিয়াল এনে যেমন বাজার মাত করা যায়, তেমনি সুলতান সুলেমানের চেয়ে ভালো সিরিয়াল বানিয়েও বাজারে রাজত্ব করা সম্ভব। চাই শুধু মেধা। ঘ্যান ঘ্যান না করে বরং মেধার খোঁজ করুন।