যেভাবে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছিল ১৯ বার
মাহমুদুল আলম : সম্প্রতি হাঙ্গেরি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির প্রেক্ষিতে এক প্রশ্নের জবাবে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট যান্ত্রিক ত্রুটিতেও হতে পারে, আবার মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও হতে পারে।’ এই ত্রুটির বিষয়ে চলছে নানামুখী তদন্ত। নিশ্চিত হবার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটি নিছকই একটি যান্ত্রিক ত্রুটি নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা। তবে এর আগেও ১৯ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এরমধ্যে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি আসে প্রথম আঘাতটি। চট্টগ্রামে ৮ দলীয় জোটের মিছিলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে গুলি চালানো হয়। পুলিশ ও বিডিআরের চালানো সেই গুলিতে ৭ জন নিহত ও তিনশত লোক আহত হয়।
পরের বছর ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট দ্বিতীয় হামলাটি হয়। এই হামলা হয় রাজধানীতে ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনে। রাত ১২টার দিকে ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর ওই হামলার সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাসভবনেই ছিলেন। হামলাকারীরা ৭-৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটির বিস্ফোরণ হয়নি।
দুই বছর পর ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে উপ-নির্বাচন চলাকালে রাজধানীর গ্রীনরোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান শেখ হাসিনা। সেখানে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির একদল কর্মী গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ শুরু করে। ২০-২৫ রাউন্ড গুলি ও বোমাবর্ষণ হয়। তিন বছর পর ১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রেল স্টেশনে ঢোকার মুখে তাকে বহনকারী ট্রেন লক্ষ্য করে গুলি হয়। নাটোর স্টেশনে সমাবেশ পন্ড করার জন্য আগে থেকে অসংখ্য বোমা ফাটানো হয়। ওই হামলার টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৫ এর ৭ ডিসেম্বর আসে পঞ্চম আঘাতটি। ওইদিন ধানম-ির রাসেল স্কোয়ারে সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন ওই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। ওই সমাবেশেও শেখ হাসিনার উপর গুলিবর্ষণ করা হয়। পরের বছর ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ আসে পরের আঘাতটি। সেদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্মরণে বক্তৃতা করেন তিনি। বক্তৃতা শেষ করার পরপরই হঠাৎ করে একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ চলতে থাকে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হন।
পরের ঘটনাটি ছিল হত্যার এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। একটি সংবাদপত্রে ওই পরিকল্পনা ফাঁসের খবরটি প্রকাশিত হয়। এতে শেখ হাসিনা ও তার সন্তানসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণার একটি ই-মেইল চালাচালির খবর আসে। মেইলটি পাঠিয়েছিলেন ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। শেখ হাসিনাকে হত্যা, গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির লক্ষ্যে ই-মেইল পাঠানোর অভিযোগে শোয়েব চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলাও দায়ের করা হয়েছিল।
২০০০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তার জনসভাস্থলের অদূরে ও হ্যালিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখে। ওই বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। বোমাটির বিস্ফোরণ হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জনসভাস্থলে উপস্থিত শেখ হাসিনাসহ সব মানুষের প্রাণ।
পরের বছর ২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। জঙ্গি সংগঠন হুজি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেখানেও বোমা পুঁতে রাখে, যা গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে। হুজি এই হামলা চেষ্টার কথা পরে স্বীকারও করে।
শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সিলেটে আলীয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন স্থানে হুজির পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে একই বছর ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। নির্বাচনি প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওইদিন সিলেট গিয়েছিলেন। রাত ৮টার দিকে জনসভাস্থল থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দুই জনের মৃত্যু হয়।
২০০২ সালের ৪ মার্চ যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। ওই বছর ২৯ সেপ্টেম্বর হামলাটি ছিল আরও পরিকল্পিত। সেদিন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তার গাড়ি বহরে হামলা চালানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীন জোটের এমপির প্রত্যক্ষ মদতে সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়।
২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর প্রথম হামলাটি হয় ২ এপ্রিল বরিশালে। সেদিন জেলার গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপির ঘাতক চক্র। আর ২১ আগস্ট হয়েছে বহুল সমালোচিত ও ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা। এতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতা অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও, আকস্মিক এই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আরও ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত হন। হামলায় আরও ৪শ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
শেখ হাসিনাকে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে স্থানান্তর করা হয়। ওই সময় শেখ হাসিনার খাবারে ক্রমাগত বিষ দিয়ে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সেøা পয়জনিংয়ের কারণে সেখানে আটক থাকাকালে শেখ হাসিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার লক্ষ্যে একটি সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা পরে ব্যর্থ হয়ে যায়। বিশ্বজুড়ে তথ্য ফাঁসে আলোচিত প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস প্রকাশিত সৌদি আরবের এক গোপন বার্তায় দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি লে. ক. শরিফুল হক ডালিম এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিন দেশে বসে এ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনা চলছিল এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য এতে জড়িত ছিলেন। শুধু তাই নয়, হংকংয়ে বসবাসরত এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এ পরিকল্পনায় অর্থায়ন করেন বলে গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৪ সালের শেষ দিকে প্রশিক্ষিত নারী জঙ্গি দ্বারা মানব বোমায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি চেষ্টা হয় বলেও নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দারা। পরে তা অনেকটা প্রকাশও হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি স্বীকার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গি শাহানুর আলম। রাজীব গান্ধী হত্যাকা-ের মতো নারী ‘মানববোমা’ ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা হয়েছিল। এজন্য ভারতে দুটি মাদ্রাসায় নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ১৫০ জন নারী ও ১৫০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। এদের নেতৃত্বে রয়েছে ১৩ জঙ্গি দম্পতি। বাংলাদেশে সেই সময় প্রশাসনের কড়া নজরদারি থাকায় পরিকল্পনা ভেস্তে যায় তাদের।
গত বছর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় যাওয়ার পথে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কাওরান বাজারে জামা’আতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) জঙ্গিরা বেশ কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড় থেকে পালিয়ে আসা জেএমবির জঙ্গিরাই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে বোমা হামলা চালায় বলে তখন গোয়েন্দা তথ্য মেলে।