রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে ছাড়া উচিত এপেক্স বডির হাতে : কয়েস সামী বাংলাদেশ ব্যাংককে দুইভাগ করা উচিত
কালাম আজাদ: ব্যাংক খাতকে ঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দুইভাগ করা উচিত। এর মধ্যে একভাগ থাকবে তদারককারী ও প্রয়োজনীয় সুবিধাদানকারী (প্রয়োজনে বিভিন্ন নিয়মনীতি সংশোধন ও নির্দেশনাসংবলিত প্রজ্ঞাপন জারি করা) হিসেবে এবং অপরভাগের কাজ হবে মুদ্রা ও মুদ্রানীতি নিয়ে। আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও যে কিছু ভুলত্রুটি রয়েছে; তা অস্বীকার করার জো নেই। একইভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেও অনিয়ম হচ্ছে। এ অনিয়ম রোধের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন না রেখে কোনো ‘এপেক্স বডি’র হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। যে বডিতে অবসরপ্রাপ্ত সৎ ও যোগ্য ব্যাংকারদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতা ও ব্যুরোক্রেটদেরও রাখা যায়। এ প্রতিবেদকের কাছে ব্যাংক খাত সম্পর্কে এমন অভিমত ব্যক্ত করলেন এবি ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সি এম কয়েস সামী। বিশিষ্ট এ ব্যাংকার বলেন, ডাক্তারদের জন্য বিএমএ এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, ব্যাংক মালিক ও ব্যাংকারদের মোট দুটি সংগঠন থাকার পরও সেগুলো তেমনভাবে কার্যকর নয়। অথচ ব্যাংক খাত তথা আর্থিক খাত নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মতামত থেকে শুরু করে দেশের অর্থনীতি নিয়ে কাজ করার জন্য সাবেক ও বর্তমান ব্যাংকারদের সমন্বয়ে ব্যাংকারদের একটি প্রতিষ্ঠিত সংগঠন (ব্যাংকার্স ক্লাব) থাকা জরুরি। যে সংগঠন মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকা- নিয়েও কথা বলতে পারবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাইক্রো (ছোট) নয় ম্যাক্রো (বড়) বিষয় নিয়ে কাজ করা উচিত।
সি এম কয়েস সামী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। প্রয়োজনে গভর্নরের এক দফার মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। কারণ কেউ যদি জানে, তার দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ (মেয়াদ বৃদ্ধি) হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবে সে কারও কোনো কথায় কান না দিয়ে সঠিকভাবে তদারকির দায়িত্ব পালন করতে পারবে। একইভাবে বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ক্ষেত্রেও এ ধরনের নিয়ম করা উচিত। এতে দ্বিতীয় দফায় নিয়োগের জন্য পরিচালনা পর্ষদের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেবেন না এমডি। এক্ষেত্রে এক ব্যাংকে এক দফায় এমডির মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। তবে পূর্বের ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট এমডির পুনর্নিয়োগ না হলেও তিনি তার বয়স অনুযায়ী অন্য ব্যাংকে এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
স্প্রেডের (ঋণ ও আমানতের সুদহারের পার্থক্য) বিষয়ে সি এম কয়েস সামী বলেন, খালি চোখে স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হলেও আসল চিত্র তা নয়। কারণ বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণে রয়েছে বিপুল পরিমাণে হিডেন চার্জ। ফলে কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১২ সালে নির্ধারিত স্প্রেডের সীমা মেনেছে বলে মনে হলেও আসলে ব্যাংকটির এক্ষেত্রে অনিয়ম থাকতে পারে। যাতে আমানতকারী যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হন, তেমনি ক্ষতিতে পড়েন ঋণ গ্রহীতাও।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক সম্পর্কে সি এম কয়েস সামী বলেন, ব্যাংকটির এখনো কোনো ক্লিয়ারিং হাউসের সদস্য নয়। এ কারণে ঋণ গ্রহীতা প্রবাসীরা তাদের কিস্তির অর্থ প্রেরণ করতে অনেক হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখা থাকা আবশ্যক। কিন্তু বিমান বন্দরগুলোতে শাখা থাকার পরও সেগুলো কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। সি এম কয়েস সামী বলেন, বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ভুগছে। অথচ ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি পূরণ সাপেক্ষে তা প্রয়োজনমাফিক বাড়াতে কল্যাণ ফান্ড থেকে শুরু করে আরও কিছু ফান্ড থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়।
২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আর্থিক বিবরণীতে ভুল তথ্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সে সময় আপনি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি ছিলেন, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্যÑ এমন প্রশ্নে সি এম কয়েস সামী বলেন, ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ঋণসীমা হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এখানে অন্য বাণিজ্যিক বা বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে একত্রিত করলে হবে না।’ সবমিলিয়ে তার সময়ের আর্থিক বিবরণীতে কোনো ভুল তথ্য দেওয়া হয়নি- বিষয়টি প্রমাণের জন্য তিনি এ প্রতিবেদককে কাগজে-কলমে ঋণ, ঋণ গ্রহীতা ও আদায় সম্পর্কে বেশকিছু বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করেন।
অপর এক প্রশ্নে কয়েস সামী বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের কোনো ঋণ গ্রহীতা বিদেশে গিয়ে কোনো কারণে স্বল্প সময়ে দেশে ফেরত এলে বা সে দেশে মৃত্যুবরণ করলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলে- সেই প্রবাসীর ঋণের অর্থ আদায় না করে, তাকে সহযোগিতার জন্য ইন্সুরেন্স করা হয়েছিল। বায়রার সঙ্গে যৌথভাবে করা সেই ইন্সুরেন্সের কার্যক্রম স্থগিত হওয়ার পরে আমি নিজ উদ্যোগে ইন্সুরেন্স করি। যা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে।
প্রবাসীদের নিয়ে দীর্ঘ তিন বছর কাজ করা এ ব্যাংকার বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম একটি বড় ভুল হলো- মালয়েশিয়ার সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতিতে লোক পাঠানোর চুক্তি করা। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে বায়রাকে এভাবে বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি। যদি বায়রার লোক পাঠানোর সুযোগ অব্যাহত থাকত, তবে এখন মালয়েশিয়ায়ই আরও কয়েক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতো।’
সি এম কয়েস সামী বলেন, ব্যাংকগুলোকে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাত আরও প্রসারিত করা উচিত। কারণ প্রতিবেশী ভারতে একটি ব্যাংকের এডি (অথরাইজড ডিলার- বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী) শাখা খুলতে যেখানে এক সপ্তাহেরও কম সময় লাগে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যাংকের এডি শাখার লাইসেন্স প্রদান করতে সময় নেয় অন্তত তিন থেকে চারমাস, যা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।
‘দেশে ৪৭টি তফসিলি ব্যাংক থাকার পরও নতুন আরও নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলো পর্যায়ক্রমে ব্যবসায়িক কার্যক্রমেও এসেছে। এ অবস্থায় বাজারে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বাজারে চতুর্থ প্রজন্মের নয়টি ব্যাংক আসাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন’- এমন প্রশ্নের জবাবে সি এম কয়েস সামী বলেন, নতুন ব্যাংকের অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আর্থিক সূচকে কোনো ব্যাংক যদি মাত্রাতিরিক্ত খারাপ করে, তাহলে প্রয়োজনমাফিক পুরনো ব্যাংকের সঙ্গে নতুন ব্যাংককে একীভূতকরণ (মার্জ) করা যেতে পারে। যাকে আমরা ‘মেগা মার্জ’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি। এতে দুটি ব্যাংকের একসঙ্গে পথচলায় দুর্বলতা কেটে যাবে- এটাই স্বাভাবিক।
বেসরকারি খাতের ব্যাংক সম্পর্কে সি এম কয়েস সামী বলেন, মনোনীত পরিচালকদের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা আবশ্যক। তিনি বলেন, এক সময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর অনেক সুনাম ছিল। এখন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের সঙ্গে কিছু বেসরকারি খাতের ব্যাংকের সুনামও ম্লান। অথচ ১৯৮২ সালে গার্মেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে বর্তমানে এ শিল্পকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অবস্থানে নিয়ে আসতে কিন্তু বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোরই অবদান অনস্বীকার্য। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোকে নিজেদের স্বার্থেই উদ্যোক্তা তৈরির দিকে নজর দিতে হবে বলেও মত দেন তিনি। এক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের ঋণ নির্দিষ্ট কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে সীমাবদ্ধ না রেখে সব ব্যাংককেই এ ধরনের সুযোগ দেওয়া উচিত বলেই মনে করেন সি এম কয়েস সামী। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আমলারা যেখানে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে; সেখানে কিছু আমলার কারণে ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা’ শব্দটি এখনও আমরা ভুলতে পারছি না। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।