থানায় অভিযোগের পর গ্রামে ‘অবরুদ্ধ’ সাঁওতালরা
বিডিনিউজ: এক মাস আগে চিনিকলের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর মাদারপুরে গির্জার মাঠ ও স্কুলে আশ্রয় নিয়ে থাকা সাঁওতালদের অভিযোগ, তাদের গ্রাম থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। গত ৬ নভেম্বর হামলার পর দেশজুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা জানানো হয় সমতলের এই নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের। সেই ‘নিরাপত্তার’ মধ্যে এখন ‘অবরুদ্ধ’ তারা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকল সংলগ্ন গ্রামটিতে গত শনিবার গিয়ে দেখা যায়, গির্জার সামনের মাঠে কেউ কেউ কলাগাছের পাতা দিয়ে ছোট ছোট কুঠুরি বানিয়ে, আবার কেউবা ত্রাণ হিসেবে পাওয়া তাঁবু টানিয়ে আশ্রয়স্থল বানিয়েছে। অনেকে থাকছেন পরিত্যক্ত স্কুলঘরে খড় বিছিয়ে। মাঠে গর্ত করে চুলা বানানো হয়েছে শতাধিক।
মাদারপুর গ্রামের বার্নাবাস টুডু বলেন, “মাদারপুর ও জয়পুর গ্রাম দুটি ঘিরে রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন। “তাদের কাজ সাঁওতালদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়া ও অন্য কাউকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়া। ফলে প্রায় এক মাস ধরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছি আমরা।”
গত সোমবার উত্তরাঞ্চলজুড়ে ‘আদিবাসীদের’ ডাকা প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসেবে গাইবান্ধায় মানববন্ধনে অংশ নিতে বাধা ও হুমকির পর থেকে সাঁওতালরা ভয় ও আতঙ্কে রয়েছে। সাঁওতালদের অভিযোগ, মামলার অভিযোগ থেকে সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদের নাম প্রত্যাহারের জন্য নানারকম চাপ দেওয়া হচ্ছে তাদের। সাঁওতালদের মামলার ওই আবেদন থেকে আওয়ামী লীগের ওই সংসদ সদস্যের নাম প্রত্যাহারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালিত হতে দেখা যায় গোবিন্দগঞ্জে।
মাদারপুর গ্রামের বাসিন্দা রুমিলা কিসকু বলেন, “আমাদের ওই দিকে (ইক্ষু খামার) যাইতে দেয় না। “গত ২৯ দিনেও আমরা ওই দিকে যাইতে পারি নাই। আপনারা আসছেন বলে এইখানে (মাঠের পাশে) দাঁড়াইতে দিছে। না হলে গালি দিয়ে সরাই দিত।”
সাঁওতালদের চলাচলে বাধার অভিযোগের বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘চলাচলে কোনো বাধা নেই। এ ধরনের কোনো অভিযোগও আমার জানা নেই।’
রুমিলা কিসকু উচ্ছেদের জন্য চিনিকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুলিশকেও দায়ী করেন, যদিও পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ‘পুলিশেরাই আমাদের গুলি করছে। আগুন জ্বালিয়ে দিছে। যখন আগুন লাগে, তখন আমি এখানে দাঁড়িয়ে দেখতেছিলাম। প্রশাসনের লোকেরা এবং পুলিশ প্রথমে আগুন দেয়, পরে গুলি চালায়।’
বার্নাবাস টুডু বলেন, গত সোমবার (২৮ নভেম্বর) উত্তরাঞ্চলজুড়ে আদিবাসীদের ডাকা প্রতিবাদ সমাবেশের অংশ হিসেবে গাইবান্ধায় মানববন্ধনে অংশ নিতে বাধা ও হুমকির পর থেকে সাঁওতালরা ভয় ও আতঙ্কে রয়েছে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের পক্ষে থোমাস হেমরম বাদী হয়ে গত ২৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ থানায় অভিযোগ দাখিলের পর থেকে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। ‘প্রায় প্রতিদিনই অভিযোগ থেকে এমপির নাম প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে এমপির লোকজনরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার পাশাপাশি সাঁওতালদের হুমকি দিচ্ছে।’
সংসদ সদস্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে গত শনিবার সমাবেশ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। গোবিন্দগঞ্জ প্রেস ক্লাব চত্বরে এই সমাবেশে সাঁওতালদের করা অভিযোগের আসামি জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন ফকুও ছিলেন।
গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম তার বিরুদ্ধে আসা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তার ‘জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে। ‘এলাকার লোক আমাকে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে কে কখন কাকে হুমকি কিংবা বাধা দিচ্ছে, এটা তো আমি জানি না। কিন্তু একটি গোষ্ঠী আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সাঁওতালদের ব্যবহার করে ‘মিথ্যা প্রপাগান্ডা’ ছড়াচ্ছে।’
গত ৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে আখ কাটতে গেলে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের সংঘর্ষ হয়। এতে তিনজন সাঁওতাল মারা যান, আহত হন অনেকে। পরে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে সাঁওতালদের ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, যারা নিজেরা ওই জমির মালিকানার দাবিদার।
ঘর হারানো কয়েকশ সাঁওতাল এখন ত্রাণের সহায়তার উপর নির্ভর করে চলছে। তারা বলেন, ত্রাণ পেলে রান্না হয়। নাহলে বেশির ভাগ চুলায় আগুন জ্বলে না।
খোলা মাঠে ঠাঁই নেওয়া কোমল ফুলমতি মুরমু (৫৫) বলেন, ‘ওইদিন তার কাঁথা-বালিশ-তোষক সব পুড়ে গেছে। দুটি মুরগি ও একটি ছাগল ছিল, তা লুট হয়ে গেছে। এখন চাল নাই, চুলো নাই। কেউ দিলে খাই, না দিলে না খাই।’
উচ্ছেদের পর ওই জমিতে সাঁওতালদের চাষ করা ধান পরে আদালতের নির্দেশে তাদের বুঝিয়ে দিতে শুরু করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
গত শনিবার পুলিশ পাহারায় সাঁওতালদের চাষ করা ধান দ্বিতীয় দফায় কাটা শুরু হয়েছে। জমিতে ওই দিনই মাড়াইয়ের পর ৫০ বস্তা ধান সাঁওতালদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বিকালে মাদারপুর ও জয়পুরপাড়া সাঁওতাল পল্লীর ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ৫শ কম্বল ও ৪শ লুঙ্গি বিতরণ করে সাফিয়া আসাফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও গাইবান্ধা-৪ গোবিন্দগঞ্জ আসনের বিএনপিদলীয় সাবেক সাংসদ শামীম কায়সার লিংকন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গোবিন্দগঞ্জ পৌর বিএনপির সভাপতি ফারুক আহমেদ, সাফিয়া আসাফ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মোতাকাব্বের আলী, আনারুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম প্রমুখ। সম্পাদনা: সাইদ রিপন