দেশে ঢোকা রোহিঙ্গারা সাবাড় করছে পাহাড়, তৈরি করছে বাড়ি
ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার: পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সে দেশের সেনাবাহিনীর ব্যাপক দমন-পীড়নের কারণে বেশ কয়েকদিন ধরে সীমান্ত পথে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারা এখন ঘরবাড়ি বানানোর জন্য পাহাড় কেটে সাবাড় করছে। আর গ্রামীণ জনপদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। রোহিঙ্গারা এখন অনেকের বাড়িঘরে আশ্রয় নিলেও তারা এখন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে। আর মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের সহযোগিতা করছে স্থানীয়রা। সচেতন মহলের দাবি অতীতে আমরা দেখেছি রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনসহ নানান সমস্যা। এখন সেটি আরও জোরদার হতে পারে এবং খুব দ্রুত নতুন আসা রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে তাদের আলাদা আইডি দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার।
কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলীর বাসিন্দা মনিরুল হক মুন্সি বলেন, মাসখানেক ধরে মায়ানমারে চলমান সহিংসতার কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে এটা সবাই জানে। তাদের একটি অংশ এখন আমাদের আশপাশে দেখতে পাচ্ছি। এমনিতেই বৃহত্তর পাহাড়তলী এলাকা আগে থেকেই রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। তাই তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে এসে তারা আশ্রয় নিয়েছে। এখন তারা নিজেদের জন্য ঘরবাড়ি তৈরি করছে এবং পথেঘাটে বের হচ্ছে কাজের সন্ধানে। বাড়িঘর তৈরি করতে গিয়ে এখানে বেশ কয়েকটি পাহাড় কাটা পড়েছে। তবে এসব পাহাড় কিন্তু বিক্রি করছে স্থানীয়রা। আমার জানা মতে, শুধু পাহাড়তলীতে কমপক্ষে নতুন করে ২০০/২৫০টি পরিবার এসেছে। তারা এখন স্থায়ী হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে।
স্থানীয় সমাজসেবক শেখ সেলিম বলেন, আসলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি আমাদের মানবিকতা আছে, কিন্তু দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আমরা সেই মানবিকতা বেশি দেখাতে পারব না। এই যে তারা এখন বাড়িঘর তৈরি করার জন্য পাহাড় কাটছে, তাদের জ্বালানির জন্য লাকড়ির ব্যবস্থা করতে গিয়ে বন উজাড় করবে, কাজের সন্ধানে গিয়ে আমার দেশের শ্রমবাজার দখল করবে সেটা কার ক্ষতি হচ্ছে। আমি জেনেছি শহরের রুমালিয়ারছড়া গরুর হালদা নামক স্থানে পাহাড় কেটে তারা বাড়িঘর তৈরি করছে। আর এটা আমরা কতদিন বহন করব। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এত বেশি সমৃদ্ধ না যে আমরা তাদের সবকিছু মেনে নিতে পারব। আমার মতে, যারা নতুন এসেছে তাদের একটি তালিকা করে চিহ্নিত করে রাখা দরকার এবং যত দ্রুত সম্ভব তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আমাদের উপর চাপ না দিয়ে মায়ানমার সরকারের উপর কেন চাপ দিচ্ছে না আন্তর্জাতিক মহল।
উখিয়ার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও সুজন সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, যে যাই বলুক আমার জানা মতে কমপক্ষে ২০/৩০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে প্রবেশ করেছে। তারা এখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। খুব কম সংখ্যক আছে যাদের কোনো পূর্বপরিচিতি ছিল না তারাই ক্যাম্পে স্থান নিয়েছে। মানবিক দিক বিবেচনা করা হয়েছে সেটা ঠিক আছে কিন্তু আমার যদি নিজের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে তাহলে আমি কার কাছে সহযোগিতা চাইবো। একটি সময় আসবে তারা এখানে সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে পড়বে। স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিবে। সামাজিক সিদ্ধান্ত দিতে চাইবে। তখন কি করবে স্থানীয় লোকজন। আর তাদের অপরাধ প্রবণতা আমরা দেখেছি কিছুদিন আগেও আনসার ক্যাম্পে হামলা করে অস্ত্র লুটসহ হত্যা করেছে রোহিঙ্গারা। এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। আমি আশঙ্কা করছি এক সময় পার্বত্য শান্তি চুক্তির মত আরও একটি শান্তিচুক্তি রোহিঙ্গাদের সাথে করতে হবে।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন কক্সবাজার জেলা কমিটির সভাপতি প্রফেসর এম এ বারী বলেন, দীর্ঘ ২ দশক ধরে আমাদের ঘাড়ের উপর রোহিঙ্গার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। সেই ভার বহন করতে গিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তাই হারিয়ে ফেলেছি। এখন আরও নতুন করে রোহিঙ্গা আসছে সেটা আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকি হবে বলে আমি মনে করি। আমার মতে, মায়ানমার সেনাবাহিনীর একটি কৌশল ছিল আরাকান রাজ্যের মুসলমানদের নির্যাতন করে তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই ফাঁদে আমরা কেন পা দিচ্ছি? আসলে এখানে মায়ানমারের পরিকল্পনাই জয়ী হয়েছে। আমাদের মানবিকতা জয়ী হলেও আমরা বহুভাবে হেরে গেছি। সেটা আস্তে আস্তে সবাই বুঝতে পারবে। যাই হোক এখন যারা নতুন এসেছে তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে না দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করে পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ ব্যপারে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং চকরিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, মানুষ হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করেছি। এখন রাষ্ট্র হিসেবে সরকারের দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা সত্যি যে আগে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের পর্যটনসহ সবকিছুতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজারের পিছিয়ে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল রোহিঙ্গা। তাই এখন আরও নতুন করে রোহিঙ্গা এসেছে সেটা স্বীকৃত। তাদের নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিকল্পনায় বেশি প্রাধান্য পাবে যেন তাদের আবারো নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যায়। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম