শুভ জন্মদিন হে বিদেশি বীরপ্রতীক
অজয় দাশগুপ্ত
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেহাত তরুণ, কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে পারেননি। ভয়াবহতম নৃশংসতা তাকেও ছেড়ে কথা বলেনি। গেরিলাযুদ্ধ শিখে নাৎসি বিরোধী লড়াইয়ে সামিল তিনি একাত্তরে ছিলেন ঢাকা বাটা কোম্পানির প্রধান। বাংলাদেশিদের উপর পাকি নির্যাতন আর অঘোষিত যুদ্ধে ভয়ানক নাখোশ মানুষটি পথ বেছে নিতে বিলম্ব করেননি।
কী করেননি আমাদের জন্য? গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিফৌজদের গড়ে তোলা, তাদের সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও যুদ্ধ করেছিলেন। কতটা অবদান থাকলে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিলেন, সেটা বুঝলেও বদলে যাওয়া দেশ বা সমাজ তাকে মনে রাখেনি। কে ঘোষক আর কে নেতাÑ এসব তর্কে বহু আগে পথ হারানো রাজনীতির সময় নেই। নিজের দেশের লোকদের মনে না রাখা সমাজ তাকে কেন মনে রাখবে?
তিনি ছিলেন ডাচ অস্ট্রেলিয়ান। সে সূত্রে এদেশে অভিবাসী হবার পর তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। রোগশয্যায় মৃত্যুর দিনগোনা ওডারল্যান্ড কথা বলতে ইচ্ছুক ছিলেন না মোটেও। বহুকষ্টে তার স্ত্রীকে ম্যানেজ করে কথা বলার পর বুঝতে পারি, কোথায় ছিল তার ক্ষোভ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর উল্লাসিত এক কর্মচারীকে বাটার অফিস থেকে বের করে দিয়েছিলেন তিনি। কথা বলার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, বদলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য জীবনবাজি রেখে বন্দুক হাতে নেননি তারা। কি মুশকিল, যারা এই প্রশান্ত পাড়ের বাংলাদেশি তারাও খুব একটা মনে রাখেনি তাকে। দূতাবাস মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয়, বাকিরা চুপচাপ। আমি ঢাকায় লেখার পর একদা বাম নেতা একজন হঠাৎ তাকে নিয়ে শোরগোল শুরু করলেও অচিরেই তা থেমে যায়। থামবে নাই বা কেন? যিনি শুরু করেছিলেন তিনি ওডারল্যান্ডের নামটিও শুদ্ধ করে লিখতে পারেননি। না জেনেই হৈ চৈ, তারপর কবরের নীরবতা।
মহান মুক্তিযোদ্ধারাও কি তাকে মনে রাখেন? মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা প্রায়ই আমাদের তাদের পরিচয় জানিয়ে জাগ্রত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কেউ তার কথা বলেন না। ৬ ডিসেম্বর একমাত্র বিদেশি বীরপ্রতীক ডাব্লিউএস ওডারল্যান্ডের জন্মদিন। বিনষ্ট সমাজ, হাফরাজাকার বুদ্ধিজীবী আর পাকিসুশীল বা নির্মূল করার মানসে চেতনাধারীরা কেউ-ই তাকে মনে করেন না। কেন যে আমাদের জন্য লড়েছিলেন, এরা কি জানে? শুভ জন্মদিন বীর ওডারল্যান্ড।
লেখক: সিডনি প্রবাসী, কলামিস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষক
সম্পাদনা: আশিক রহমান