এরশাদ পতনের ২৬ বছর তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে লক্ষ্য পূরণ হয়নি
জাফর আহমদ: স্বৈরাচার এরশাদ পতনের ২৬ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তন হলেও এরশাদ পতনে তিন জোট রূপরেখার ভিত্তিতে যে আন্দোলন করেছিল ২৬ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
দীর্ঘ ৯ বছর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার ছিল। এ সময় আন্দোলনরত দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও গণতান্ত্রিক চর্চার অনেকগুলো সুনির্দিষ্ট অঙ্গিকারে আকাক্সক্ষা তৈরি হয়। ৯০ পূর্ববর্তী এ সব রূপরেখার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল এবং বামদলগুলোর নেতৃত্বে ৫ দল একসাথে আন্দোলন করে এরশাদ সরকারের পতন হয়। সে সময় এর বাইরে যুগপৎ আন্দোলন করে জামায়াতে ইসলামী। এর সব রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের ফলে এরশাদের পতন হলেও সে সময় আন্দোলনরত দলগুলোর যে আচরণ বিধি তৈরি হয়েছিল তা বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা থাকেনি। যদিও ৯০-এর পর থেকে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ৮ দলীয় জোটের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ও ৭ দলীয় জোট নেতৃত্বদানকারী বিএনপি ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এ সব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে মনোযোগ পায়নি।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার ব্যাপার। হঠাৎ করে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিন জোটের রূপরেখার মধ্যে তিনটি গুরুত্ব বিষয় ছিল- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার বদল; নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের সকলের অভিগম্যতা। তিনি বলেন, এখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরকার বদল হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্ধারণ হচ্ছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আরও যেটুকু বাকি আছে শিগগির হবে। গণমাধ্যমও স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে দেশের সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
ক্ষমতামুখী দলগুলো ক্ষমতার বাইরে থেকে প্রতিশ্রুতি দেয়, ক্ষমতায় গিয়ে মনে রাখে না। বিএনপি-আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় গিয়ে তা রাখেনি বলে মনে করেন তৎকালীন ৫ দলীয় জোটের অংশীজন সংগঠন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর। তিনি বলেন, ৯০ পূর্ববর্তীর চেয়ে পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তনে কিছুটা ইতিবাচক ধারা যুক্ত হলেও বড় ধরনের পরিবর্তন হয়নি। এ ক্ষেত্রে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছিল তাদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হচ্ছে।
তিনজোটের রূপরেখা রাস্তবায়নে বিএনপি পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অপর নেতা, সাংগাঠনিক সম্পাদক ও তৎকালীন ছাত্রলীগনেতা এনামুল হক শামীম। তিনি বলেন, বিএনপি চায়নি নির্দলীয় সরকার। তৎকালীন বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন ছিল। আওয়ামী লীগের নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রয়োজনে এ দাবি করে। পরবর্তীতে সরকার বদলের ক্ষেত্রে তারা নানা প্রকার গড়িমসি করে। তারা ‘ইয়াজুদ্দিন মার্কা’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চেয়েছিল। বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে ২০০৭ সালে আর্মি নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্ভব হয়েছিল। তারা ‘আজিজ মার্কা’ নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সিইসি নির্বাচনের জন্য সার্চ কমিটির ব্যবস্থা করেছিল।
গণমাধ্যমে সবার সমান সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় অর্ধশতাধিক টেলিভিশনের নিবন্ধন দিয়েছে। টেলিভিশন মানে এখন আর ‘সাহেব বিবির গোলামের বক্স’ নয়। ইচ্ছামত করে খবর প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, ৯০ পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ উদ্যোগী হয়েছে। তৎকালীন আন্দোলনের দল বিএনপি সেভাবে উদ্যোগী হয়নি। তারা এ ব্যাপারে কি করবে তা জানেও না। তারা এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনাও করে না। এর মাধ্যমে তৎকালীন শহীদ জেহাদ, বসুনিয়ার রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছে।