ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সম্মেলন নিরাপদ অভিবাসনব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানাবে বাংলাদেশ
আলোচনায় প্রাধান্য পাবে রোহিঙ্গা ইস্যু
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: আগামী ১০ ডিসেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী ঢাকায় শুরু হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী সম্মেলন। গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (জিএফএমডি) এ সম্মেলনের আয়োজন করছে। জিএফএমডির বর্তমান সভাপতি বাংলাদেশ। ওই সম্মেলনে যোগ দিতে এখন পর্যন্ত ৭৩টি দেশ ও ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রায় সাড়ে ৫০০ বিদেশি প্রতিনিধি নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে ২০ জন মন্ত্রী রয়েছেন।
এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিশ্বজুড়ে নিরাপদ অভিবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই সম্মেলনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চায় বাংলাদেশ। এছাড়া গত দুই মাস ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর চলা বর্বরতা এবং এই সম্প্রদায়কে একটি দেশ থেকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং রোহিঙ্গাদের নিশ্চিত জীবন যাপন নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলোচনা প্রাধান্য পাবে বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০ ডিসেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে জিএফএমডি সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। তিনদিনের বিভিন্ন কর্ম অধিবেশনে অভিবাসনের সুশাসন, শ্রমবাজার ব্যবস্থাপনা, ব্যয় হ্রাস, যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট সংকট, নিরাপদ ও নিয়মসিদ্ধ অভিবাসন প্রভৃতি ইস্যুতে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিরা যোগ দিবেন। বিভিন্ন দেশের সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা ৮ ও ৯ ডিসেম্বর পৃথক সম্মেলন করবেন। এবারে প্রতিপাদ্য বিষয় হলোÑ ‘সবার জন্য টেকসই উন্নয়নে অভিবাসন কাজ করে : পরিবর্তনশীল অভিবাসন এজেন্ডাই লক্ষ্য’।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, সারাবিশ্বেই নিরাপদ অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপক তাগিদ রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি হলো অভিবাসন সমস্যা। গুটিকয় দেশ বাদ দিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের বিষয়টি এখন সময়ের দাবিÑ বাংলাদেশ সেটি তুলে ধরবে সম্মেলনে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, গত দুমাস ধরে চলা রোহিঙ্গা বিষয়টিও এ সম্মেলনে আলোচনায় বড় জায়গা করে নেবে। বাংলাদেশ চায় বিশ্ব নেতারা মিয়ানমারের উপর মানবিক চাপ সৃষ্টি করবে।
বেসরকারি সংস্থার একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বিদেশে যায় দালালের মাধ্যমে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে মানুষ অবৈধভাবে বিপদসঙ্কুল সাগরপথে বিদেশে যান। বাংলাদেশ থেকে এভাবে বিদেশ যাওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই জমি বিক্রি করে বিদেশে যান। ১৮ থেকে ৩১ বছর বয়সী অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের ৯৮ শতাংশের বেশি পুরুষ। অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩৪ শতাংশ যান জমি বিক্রি করে। এদের ৩৬ শতাংশ প্রাথমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব বলছে, ২০১৫ সালে বিশ্বে মোট ৪ হাজার ৩০০ অভিবাসী অবৈধ পথে অভিবাসনের সময় মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে শুধু ভূমধ্যসাগরেই ৩ হাজার ২০০ অভিবাসী ডুবে মারা যান। আন্দামান সাগর, মধ্য আমেরিকা ও আফ্রিকা উপকূলের অভিবাসন সংকট সম্পর্কেও কমবেশি সবাই অবগত। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী একটি সুষ্ঠু, নিরাপদ, নিয়মিত ও ন্যায়সঙ্গত অভিবাসন ব্যবস্থাপনা কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সবাই অনুভব করছেন।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণ ও সঠিক অভিবাসন ব্যবস্থাপনা প্রণয়নে একটি বৈশ্বিক নীতিমালা ঘোষণার লক্ষ্যে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী সুষ্ঠু, নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশের প্রস্তাব করা ‘গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ফর সেইফ, অর্ডারলি অ্যান্ড রেগুলার মাইগ্রেশন’-এর গুরুত্ব বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলিষ্ঠ বক্তব্য দেন। বাংলাদেশই প্রথম অভিবাসনসংক্রান্ত এ ধরনের একটি সুনির্দিষ্ট বৈশ্বিক ফ্রেমওয়ার্ক (গ্লোবাল কমপ্যাক্ট) প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশের অব্যাহত জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনে গ্লোবাল কমপ্যাক্টবিষয়ক প্রস্তাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন অন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট’ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ ধারাবাহিকতায় গ্লোবাল কমপ্যাক্ট চূড়ান্তকরণের জন্য আগামী ২ বছরব্যাপী জাতিসংঘে একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে, যা ২০১৮ সালে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে গৃহীত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, জিএফএমডির বর্তমান সভাপতি বাংলাদেশ। গত বছরের অক্টোবরে জেনেভাভিত্তিক এ আন্তর্জাতিক সংস্থাটির এক শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। এরপর থেকেই বাংলাদেশে জিএফএমডির শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়। ফোরামের সভাপতি হিসেবে বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০০৬ সালে জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো অভিবাসন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর ২০০৭ সাল থেকে প্রতিবছর বৈশ্বিক এ সম্মেলন হচ্ছে। এবারের আয়োজক বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, অভিবাসন ও উন্নয়নের অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সুশাসনÑ এ তিনটিকে মূল ধরে এবারের সম্মেলনে ছয়টি বিষয়ের ওপর আলোচনা হবে। অভিবাসন খরচ, মানুষে মানুষে যোগাযোগ, অভিবাসীদের গন্তব্য, অভিবাসীদের স্বার্থরক্ষা, সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি ও দুর্যোগের সময় কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে, নিরাপদ অভিবাসনের জন্য করণীয় এমন বিষয়গুলো নিয়ে এ সম্মেলনে আলোচনা ও করণীয় ঠিক করা হবে। সম্পাদনা: আলাউদ্দিন