কড়াইল বস্তিতে আগুন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মূল্যবান কিছু পাওয়ার আশা বস্তিবাসীদের!
সুজন কৈরী: গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টা। আগুনে পুড়ে যাওয়া মহাখালী কড়াইল বস্তিতে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু একটা খুঁজছেন ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা। পোড়া হাঁড়ি-পাতিল, আসবাবপত্র, টাকা-পয়সা, জামা-কাপড়ের অবশিষ্টাংশ লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছেন তিনি। পুড়ে যাওয়া ৩/৪টি ঘরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে খোঁজাখুঁজি করলেন। কিন্তু কিছুই পেলেন না। শেষ মুহূর্তে দুই-তৃতীয়াংশ পুড়ে যাওয়া স্টিলের একটি গ্লাস খুঁজে পেলেন এই বৃদ্ধা। গ্লাসটি নিয়ে পোড়া কাঠের ওপর বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে বার বার চোখ মুছছিলেন। তার নাম কি জানতে চাইলে কান্নায় ফেটে পড়েন তিনি। বিলাপ করে কিছুক্ষণ কান্না করার পর এই প্রতিবেদককে কিছু বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সর্বস্ব হারানো শোক তাকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছিল না। একপর্যায়ে তার নাম সাফিয়া বেগম বলে জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত ফরিদা বেগম জানান, বস্তিতে তার স্বামী সুরুজ মিয়ার ২৩টি ঘর ও ২টি দোকান ছিল। ঘরগুলো থেকে ২ থেকে আড়াই হাজার ভাড়া নিতেন। এই দিয়েই চলতো সংসার। তবে আগুন নেভার পর কিছুই পাননি তারা। ভাড়ার ৪০ হাজার টাকা ঘরে ছিল। জীবিকার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রায় সর্বহারা যে মানুষগুলো রাজধানীতে এসে কড়াইল বস্তিতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছিলেন, আগুনের লেলিহান শিখা সর্বস্ব পুড়িয়ে পথে বসিয়ে দিয়েছে তাদের। ঢাকার অভিজাত এলাকায় গড়ে ওঠা এই বস্তি পোশাক শ্রমিক, রিকশাচালকসহ ঢাকার নিম্ন আয়ের বহু মানুষের ঠিকানা। তাদের ছিল না আভিজাত্য বা বিলাসিতা, তবু এসব মানুষের ছিল মাথা গোঁজার একটু নিশ্চয়তা। দিনভর পরিশ্রম শেষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনতেন যে ঘরে শুয়ে, সেই ঘর পুড়ে যাওয়ায় ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব মানুষরা। আগুনে শেষ সম্বলটুকু খুইয়ে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ সহস্রাধিক মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে পড়েছে। বেঁচে থাকার জন্য, লজ্জা নিবারণের জন্য বস্ত্র, শোয়ার জন্য বিছানা- সব কিছুই পুরে ছারখার; সহায় সম্বলহীন এই মানুষগুলো এখন সাহায্যের আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে খাবার পেলেও নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে বিপাকে থাকা বস্তিবাসীর দাবি দ্রুত তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হোক । গতকাল বিকাল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ৫০০ বস্তিবাসীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ধনাঢ্য পরিবার ও বস্তির অপর বাসিন্দারা পুরাতন পোশাক দিয়ে সাহায্য করছেন ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের।
বস্তিবাসীরা জানান, বস্তির ভিতর লেপ-তোষকের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। স্থানীয় ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের সিনিয়র সভাপতি সাজ্জাদ আলম বলেন, পুরো বস্তিটি ১ ও ২ নম্বর ইউনিট (উত্তর ও দক্ষিণ) হিসেবে বিভক্ত। এখানে ৫১ হাজার ঘর রয়েছে। এগুলোতে লাখ লাখ লোক থাকেন। টিন, বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি বস্তি ঘরের মধ্যে দোতলাও রয়েছে। আগুনে ৬০০ ঘর পুড়ে গেছে। এসব ঘরের মধ্যে থাকা পরিবারের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৮০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকবেন। আপাতত যতটুকু পারছেন সাহায্য করে যাচ্ছেন।
এদিকে গতকাল দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের দেখতে যান স্থানীয় এমপি এ কে এম রহমত উল্লাহ ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন। রহমতুল্লাহ বলেন, এই পাঁচ/ছয়শ বস্তিবাসীকে সময়ের ব্যবধানে আস্তে আস্তে পুনর্বাসন করে দেওয়া হবে।
আগুন ইচ্ছাকৃত নয় : কড়াইল বস্তিতে আগুন ইচ্ছাকৃতভাবে লাগানো হয়নি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রি. জে. আলী আহমদ খান। গতকাল রাতে তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত কিংবা শত্রুতাবশত আগুন লাগানোর কোনো আলামত পায়নি ফায়ার সার্ভিস। সাধারণত ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগানো হলে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পয়েন্টে একসঙ্গে লাগানো হয়। বস্তির আগুন এক জায়গা থেকে সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, লেপ-তোষকের দোকান থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। সম্পাদনা: আজাদ হোসেন সুমন