একান্ত সাক্ষাৎকারে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন এরশাদ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি দুর্বল হয়ে পড়বে
শাহানুজ্জামান টিটু: আজ স্বৈরাচার পতন দিবস। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আজকের দিনে ছাত্রজনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন স্বৈরশাসক ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। ২৬ বছর আগে ওই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব। যিনি বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। সোমবার মুখোমুখি হয়েছিলেন আমাদের সময়.কমের সাথে। বলেছেন আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিকদলগুলোর সে সময়ের ভূমিকা। তার কাছে প্রশ্ন ছিল স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে আপনি সে সময় ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন রয়েছে যদি পরিষ্কার করেন। জবাবে হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তৎকালীন ভূমিকা নিয়ে আমি ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। আজকের প্রধানমন্ত্রী তিনি তখনও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে ওনার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওনি মনে করেছিলেন এরশাদ যদি আরও এক বছর ক্ষমতায় কনটিনিউ করে তাহলে বিএনপির অনেক নেতা জাতীয় পার্টিতে চলে যাবে। এরফলে বিএনপি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়বে।
হাবিবুর রহমান বলেন, কারণ বিএনপির অনেক নেতা তখন জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এ বিষয়গুলো আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর খেয়াল ছিল এবং এভাবে যদি আমরা এরশাদকে আরও এক বছর ক্ষমতায় রাখতে পারি তাহলে বিএনপির অনেক লোক, ছাত্রসংগঠন তো অভি নিরুরা চলেই গিয়েছিল যদিও নিরু একটা পর্যায়ে ওখান থেকে সরে এসেছিল আর অভি এরশাদের সঙ্গে থেকে যায়। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ হলের ভিপি জিএসরা অভিদের পক্ষ সর্মথন করে। শেখ হাসিনা এ কারণেই মনে করেছিলেন আন্দোলনটা কনটিনিউ করুক। তাহলে বিএনপি থেকে অনেক নেতা চলে যাবে ছাত্রসংগঠনও শক্তি হারাবে।
ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, একটা সময় এরশাদ যাবেই তখন ওনি (শেখ হাসিনা) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যেতে পারবেন। সেজন্য ওনাদের ইচ্ছা ছিল আন্দোলনটা এই মুহূর্তে শেষ না করা।
কিভাবে আপনারা ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হলেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন? জবাবে তিনি বলেন, আমি কিন্তু শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ না করে, কারোর কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে আমার নেতৃত্বে জেহাদের লাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসি। আমি সেদিন বুদ্ধি করে আমান বাবুল ছিল তাদেরকে সাথে করে নিয়ে সকল ছাত্রসমাজকে একত্রিত করার জন্য ওই লাশ নিয়ে আমি সব হলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা সিদ্ধান্ত পাল্টে জেহাদের লাশ নিয়ে ক্যাম্পাসের দিকে যেতে থাকলে পুলিশ ও বিডিআর আমাদের সেই মিছিলের উপর গুলি ও টিয়ারসেল নিক্ষেপ করে লাঠিচার্জ শুরু করে।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতা হাবিবুর রহমান বলেন, আমি ডাকসুতে যেতাম না। কারণ ডাকুস নির্বাচনের পর আমি একটি বিবৃতি দিয়েছিলাম। ডাকসু ইলেকশান নিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী ওনি মনে করেছিলেন কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচন হয়েছে। যদিও সেটা সঠিক ছিল না।
তিনি বলেন, কিন্তু লাশকে কেন্দ্র করে আমি সেদিন ডাকসুতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে আমি ডাকসুর টেলিফোন দিয়ে সর্বপ্রথম শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়েছিলাম। তখন তোফায়েল আহমেদ ফোন ধরেছিলেন। আমি বললাম আপনারা ক্যাম্পাসে আসেন, লাশ আমরা ক্যাম্পাসে নিয়ে এসেছি। এরপর আমান উল্লাহ আমান বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ফোন করেন। নাজমুল হক প্রধানকে দিয়ে হাসানুল হক ইনুকে এবং জহির উদ্দিন স্বপনকে দিয়ে রাশেদ খান মেননকে ফোন করিয়েছিলাম।
হাবিব বলেন, এরপর ম্যাডাম খালেদা জিয়া লাশ দেখতে আসেন। জিয়া হলের সামনে থেকে খালেদা জিয়া আমাকে হাত ইশারায় ডেকে বললেন হাবিব তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও আমরা আছি তোমাদের সাথে। তারপর লাশ অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হলো। ডাকসু অফিসে বসে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি পরবর্তী করণীয় নিয়ে এসময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে বলা হলো লাশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। খালেদা জিয়া আসলেন কিন্তু ততক্ষণেও শেখ হাসিনা আসলেন না। তখন আমরা ভিসিকে বললাম শেখ হাসিনা না আসা পর্যন্ত লাশ দেওয়া যাবে না। এরপর রেড ফোন দিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন দেওয়া হলো ফোন ধরলেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব সেন্টু। পরে তিনি ফোনটা শেখ হাসিনাকে দিলেন। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে বলার পর আমি বললাম আপনাকে ( শেখ হাসিনা) ক্যাম্পাসে যেতেই হবে। লাশ ক্যাম্পাসে আছে এখন যদি না আসেন আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। তারপর ওনি (শেখ হাসিনা) দলবল নিয়ে আসলেন। সর্বসম্মতিক্রমে ওনি আসার পর নাজমুল হক প্রধানকে বললাম শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবেন নাম বলেন, শেখ হাসিনা বক্তব্য দিলেন সবাইকে অ্যাড্রস করে, ওনি শপথ পড়ালেন, সবাই শপথ পড়লাম, এরপর যেই বললেন জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু তখন প্রতিবাদ করলেন ছেলেরা। তখন এলোমেলো অবস্থা হয়ে গেল।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান বলেন, স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর্যায়ে আমরা ছিলাম। আসলে এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দলের নেতারা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন অনেকে নিহত হয়েছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। শেষ পর্যায়ে আমরা ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর শহীদ নাজিম উদ্দিন জেহাদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নেতৃত্বে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে লাশকে কেন্দ্র করে মূলত আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা ছাত্রসংগঠনগুলো এক হতে পেরেছিলাম।
এই আন্দোলন করতে গিয়ে অনেকে শহীদ হয়েছেন। সর্বশেষ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের আত্মাহুতির মধ্যে দিয়ে অতিদ্রুত সরকারের পতন হলো। সেদিন সব পেশাজীবীরা এক কাতারে নেমে এসেছিলেন এবং ওইদিনই সাংবাদিকরা সিদ্ধান্ত নেয় স্বৈরাচার এরশাদের কোনো সংবাদ ছাপা হবে না। সংবাদকর্মীরাও আর সংবাদ সংগ্রহ করবে না বলে জানিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেছিলেন আমরা আর কোনো ক্লাস নেব না। সমস্ত পেশাজীবীরা সেদিন কর্মবিরতি পালন করেছিল।
২৬ নভেম্বর জিরো পয়েন্টে ছাত্রঐক্যের একটা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আমি সভাপতিত্ব করেছিলাম। পরদিন ২৭ তারিখ পত্রিকা বের হয়েছিল। ডা. মিলনের শহীদ হওয়ার পর আর কোনো পত্রিকা বের হয়নি এবং ৬ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো নিউজ পেপার বের হয়নি।