মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে চলছে বিমান ৪৫ বছরেও দক্ষ জনবল তৈরি করা হয়নি
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে ত্রুটি দেখা দিলে এবং তা যথাযথভাবে মেরামত, ত্রুটি সারানো এবং কাজ সম্পূর্ণভাবে করা হয়েছে কিনা, সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হয়েছে কিনাÑ এসব বিষয় দেখার মতো পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই বিমানে। তা না থাকায় প্রধানমন্ত্রীকে বহরকারী উড়োজাহাজে কদিন আগে কাজ করানো হলেও সেটি যে ঠিক মতো করা হয়নি, এটি তদন্ত কমিটির কাছে ধরা পড়লেও যারা এর দায়িত্বে ছিলেন তাদের কারও কাছে ধরা পড়েনি। ভিভিআইপি পরিবহনে যেখানে দায়িত্বে গাফিলতি রয়েছে সেখানে সাধারণ যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়Ñ এমন প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা বিশ্বে যেখানে বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো চলছে অ্যারোনটিক্যাল, অ্যারো স্পেস ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে, সেখানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা রয়েছে মেকানিক্যাল কাজের জন্য। আর বাংলাদেশ বিমানে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। বরং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারাই বিমানের একমাত্র ভরসা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মোকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারাই বিমানের কারিগরি দিকগুলো দেখছেন। এরা কখনো কখনো বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পেলেও অ্যারোনটিক্যালে দক্ষতা অর্জনের জন্য ডিগ্রি নিতে পারেননি। বিমানের সূত্র জানায়, বিমানের দুই শতাধিক প্রকৌশলী রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় সবাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের কয়েকজন আছেন। তবে তাদের তেমন গুরুত্ব নেই। তারা জুনিয়রও। ইঞ্জিনিয়ারদের সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশ থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা তরুণ-তরুণীরা বিমানের প্রকৌশল বিভাগে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। বরং কেউ সেখানে চাকরির চেষ্টা করলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। চাকরি দেওয়া হয় না। তারা যাতে চাকরি না পায় সেই জন্য নিয়মও করা হয়েছে সেইভাবে। তারা পড়ে আসার পর এখানে আবার দুবছর প্রশিক্ষণ নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওই প্রশিক্ষণ পিরিয়ড পাড় করলে যে চাকরি পাবে এমন নিশ্চয়তা নেই। বরং তাদের বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বিমানের প্রকৌশলীদের বেতন-ভাতা যে পরিমাণ তা একজন বিশেষজ্ঞ অ্যারোনকিট্যাল ইঞ্জিনিয়ারের জন্য যথেষ্ট নয়। বিমানের ভেতরের সিন্ডিকেট, বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা কমের কারণে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা বিমানে যেতেও অনেক সময় আগ্রহী হয় না। ফলে বিমানের প্রকৌশলীদের যে দক্ষ টিম তৈরি হওয়ার কথা তা হয়নি। এ কারণে বিমানের কারিগরি ত্রুটির বিষয়গুলো নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা হিসাবেই সব সময় রয়েছে।
বিমানের একজন সিনিয়র প্রকৌশলী বলেন, আমরা বিমানে দুইশর বেশি প্রকৌশলী রয়েছি। এরমধ্যে কয়েকজন ছাড়া সবাই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমরা মেকানিক্যালরাই সব কাজ চালিয়ে নিচ্ছি।
বিমানের জন্য অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার কিনাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দরকার। কিন্তু তাদের ডিমান্ড অনেক বেশি। এ কারণে তেমন নেওয়া হয় না। তাছাড়া আমরা মোকানিক্যালরাইতো কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। অ্যারোনটিক্যাল আর মেকানিক্যালে তেমন পার্থক্য নেই। আমরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছি।
বিমানের একটি সূত্র জানায়, কেবল প্রকৌশল বিভাগের দুর্বলতা ও দক্ষতার অভাব রয়েছেÑ এমন নয়, বিমানের প্রশাসনে, মার্কেটিংয়ে, সেলসে, সেবায়Ñ সবদিকেই সমস্যা রয়েছে। এ জন্য যতখানি বাছাই করে ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল তা করা হয়নি। বিমানের বয়স প্রায় ৪৫ বছর। এই ৪৫ বছরে বিমান বেশিরভাগ সময় লোকসানের মধ্যে থেকেছে। দায়-দেনা পরিশোধ করতে পারেনি। বিমানকে লাভজনক করার জন্য কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে। তাতেও লোকসান কাটানো সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে বিমানের লোকসান কম হয় ও ওই সময় বিমান কর্তৃপক্ষের দাবিÑ তারা লাভ করেছে। কিন্তু পরের বছরই আর সেই লাভ ধরে রাখতে পারেনি। এতে করে বিমানকে লোকসানের মধ্যেই থাকতে হয়েছে।
বিমানের বহরে বোয়িংয়ের ৭৭৭-৩০০ ইআরের মতো উড়োজাহাজ আনার পরও লাভ করতে পারছে না।
এর পেছনের কারণ জানতে চাইলে বিমানেরই একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিমানের ভেতরে সমস্যা রয়েছে। কারণ নতুন উড়োজাহাজ পাওয়ার পর যেভাবে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল তা যুগোপোযোগী করে করা হয়নি। উল্টো একের পর এক সিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। এ সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীরা বিমানে দিকে ফেরাতে পারেনি।
বিমানের প্রকৌশল বিভাগ থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভাগে লোকবল সংকট রয়েছে। এ জনবল সংকট আগে থেকেই ছিল। এখনো রয়েছে। এখন যে জনবল রয়েছে তা দিয়েও সব সময় কাজ হচ্ছে না। কারণ জনবলের বড় একটি অংশর দক্ষতার অভাব রয়েছে। এটা এখন প্রকট হয়ে উঠেছে।
বিমানের যখনই যারা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখনই বলা হয়েছে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার ব্যাপারে। কিন্তু বিমান তা ৪৫ বছরেও পারেনি। এতে করে আর্থিকভাবে বছরের পর বছর লোকসানের পরিমাণ বাড়ায় দেনা বেড়েছে বিমানের।
বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও বিমানকে ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজে ত্রুটির কারণে যে ঘটনা ঘটেছে ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি যারা ওই উড়োজাহাজের দায়িত্বে ছিলেন তাদের দায়িত্বে অবহলো ও গাফিলতির কথা তুলে ধরেছে। এ কারণে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। বিমানের কর্মকর্তাদের অবহেলা যে ছিল তা সত্য। ঘটনায় দায়ীরা কিছুতেই পার পাবেন না। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যাদের কারণে ঘটনা ঘটেছে তাদের সবাইকে শাস্তি পেতে হবে।
সূত্র জানায়, বিমানের যাদের ব্যর্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর উড়োজাহাজে দুর্ঘটনা ঘটেছে ও যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তারা বিভাগের প্রকৌশল ও কারিগরি বিভাগের। যাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এর মধ্যে প্রকৌশলী এসএম রোকোনুজ্জামান, সামিউল হক, লুৎফর রহমান, মিলন চন্দ্র বিশ্বাস, জাকির হোসেন এবং টেকনিশিয়ান ছিদ্দিকুর রহমান।
বিমানের পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক একজন সভাপতি বলেন, বিমানে অদক্ষ লোক অনেকেই কাজ করছে। এর কারণ বিমানের নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকবারই অভিযোগ উঠেছে। যতবারই বিমানের শীর্ষ পর্যায় থেকে প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই ইউনিয়নের কারণে তা সম্ভব হয়নি। আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিমানের ফ্লাইট বন্ধও রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিকূলতা কাটানোর জন্য প্রয়োজন ছিল সাংগঠনিক কাঠামো ও সঠিক জনবল পরিকল্পনা তৈরি করা। সেটি হয়নি। বিমানে দক্ষতার অভাব ছাড়াও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকবলের অভাব রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি।
বিমানের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিমানে নতুন উড়োজাহাজ যোগ হওয়ার পর এর উন্নতির জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল এরমধ্যে একটি হচ্ছে দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং মান নিয়ন্ত্রনব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেবার মান বাড়ান। সেবার মান বাড়িয়ে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করা। সেটি সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর বিমানের ত্রুটি ধরা পড়ার পরও দায়িত্বে অবহেলা ও অদক্ষতার বিষয়টি নতুন করে ধরা পড়েছেÑ এমন নয়। তবে আলোচনায় এসেছে। এবার সময় এসেছে এখানে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এ প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করার জন্য ও সেবার মান বাড়িয়ে যাত্রীদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি তাদের আস্থা ফেরাতে যত বাধাই আসুক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীও বিমানের ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছেন। দক্ষ জনবল গড়ে তোলা, অযোগ্যদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন।
বেসিামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানে কেবল লোকবল নিয়োগ করলেই হবে নাÑ এরমধ্যে যে ইউনিয়নের প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে সেটাও যাতে যখন তখন বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করা কিংবা কর্মবিরতির ঘোষণা করতে না পারে। এর আগে একাধিকবার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। সম্পাদনা: আলাউদ্দিন