আজ ঢাবিতে প্রথম জানাজা সকাল ১১টায়, দ্বিতীয় জানাজা ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল আর নেই
উম্মুল ওয়ারা সুইটি, আনিসুর রহমান তপন ও সুজন কৈরী: প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, কবি মাহবুবুল হক শাকিল মারা গেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের সামদাদো রেস্টুরেন্টে তিনি মারা যান। ধারণা করা হচ্ছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটেছে। আজ বুধবার সকালে তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নেওয়া হবে। এরপর বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাজা হবে। সেখান থেকে মরদেহ তার বাড়ি ময়মনসিংহের বাগমারায় নেওয়া হবে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় তার মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। এদিকে কবি, লেখক ও তুখোড় এ রাজনীতিকের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। মিডিয়াবান্ধব এ রাজনৈতিক সংগঠকের মৃত্যু যেন মেনে নিতে পারছেন না গণমাধ্যমকর্মীরা। সদা হাস্যোজ্জ্বল শাকিল ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীদের অতি আপনজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব শাকিলের জন্য ফেসবুকে নেমে আসে আর্তি, আহাজারি। যেন কেউই এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। একইভাবে শাকিলের জন্য নিজ দল আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখেও কান্নার জল গড়াতে দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, শাকিলের মৃত্যুর খবরে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শাকিলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এবং ছাত্রনেতা, কবি ও লেখক হিসেবে তার অবদানের কথা স্মরণীয়। শেখ হাসিনা বলেন, তার মৃত্যুতে জাতি একজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক ও দক্ষ সংগঠককে হারালো। তিনি আরও বলেন, একজন ছাত্রনেতা হিসেবে শাকিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
শাকিলে মৃত্যুতে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
গতকাল দুপুরে শাকিলের মৃত্যু সংবাদ জানাজানি হওয়ার পর থেকেই গুলশানের সেই রেস্টুরেন্টে রাজনীতিক, কবি, সাংবাদিক ও শাকিলের পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের ভিড় জমে।
শাকিলের গাড়িচালক হেলাল বলেন, শাকিলের অসুস্থ হওয়ার খবরটি প্রথম তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার হেলালকে জানায় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। তারপর হেলাল বাসায় ফোন করলে শাকিলের ছোট ভাই বাবু ও শ্যালক অমিত এবং স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে আসেন। পরে একে একে শাকিলের রাজনৈতিক সহকর্মী, বন্ধু ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও উপস্থিত হন।
হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানতে পারে দ্বিতীয় তলায় শাকিল অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি গতকাল রাত থেকেই ওই হোটেল কক্ষে অবস্থান করছিলেন। দুপুরে ড্রাইভার হেলালকে ফোন দিলে তিনি তার আত্মীয়স্বজনকে বিষয়টি জানান। আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে রেস্টুরেন্টের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে হেলাল দেখেন একটি কম্বল গায়ে জড়ানো অবস্থায় শুয়ে আছেন কবি। পরে আরও লোকজন এবং একজন ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়। ডাক্তার উপস্থিত হয়ে সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে শাকিলকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ঘটনার পর রেস্টুরেন্টে উপস্থিত আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত হলে পরিবারের সদস্যরা তাদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকেন। ফলে সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এ সময় সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে শাকিলকে নিয়ে বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করছিলেন। কেউ কেউ কান্না লুকাতে চাইলেও তা পারছিলেন না। অনেকে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন। সাংবাদিক শাইখ সিরাজ ও মোজাম্মেল বাবুসহ অনেকেই ঘটনাস্থলে হাজির হন।
ছুটে গিয়েছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী ও আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং দলের সভাপতিম-লীর সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীসহ অনেক নেতাকর্মী।
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সামদাদোর বাইরে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, শাকিলের মরদেহ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে। বুধবার ময়নাতদন্ত শেষে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জানাজা হবে। এরপর তার মরদেহ নেওয়া হবে তার নিজ শহর ময়মনসিংহ। সেখানে বাঘমারা এলাকায় নিজ বাড়িতে সন্ধ্যায় তার লাশ দাফন করা হবে।
এদিকে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ রেস্টুরেন্টের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, ধারণা করা হচ্ছে শাকিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর বিস্তারিত কারণ জানা যাবে।
এর আগে ঘটনাস্থল থেকে গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বিকাল ৪টা ১০ মিনিটের দিকে সামদাদোর সাত কর্মীকে পুলিশের ভ্যানে তুলে নিয়ে যান। তবে এ বিষয়ে ওসি সিরাজুল মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সিআইডির একটি দল ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। বিকাল ৫টার দিকে পুলিশের ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা রেস্তোরাঁর ভেতরে প্রবেশ করেন।
জানা গেছে, শাকিলের মৃত্যুর খবর শুনে ময়মনসিংহের বাড়িতে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন তার বাবা-মা। শোকসন্তুপ্ত পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে শহরের ৩৮ নম্বর বাঘমারার বাসায় ছুটে যান ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, বিভাগীয় কমিশনার জিএম সালেহ উদ্দিন, পুলিশের রেঞ্জ ডিআইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, জেলা প্রশাসক খলিলুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পৌর মেয়র ইকরামূল হক টিটু, জেলা নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি আনিসুর রহমান খানসহ প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শাকিল ১৯৬৮ সালের ২০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জহুরুল হক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বর্তমানে জেলা পরিষদের প্রশাসক। মা নূরুন্নাহার খান শিক্ষকতা করেন। শাকিল একটি কন্যাসন্তানের জনক।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নবগঠিত আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেল সিআরআই পরিচালনার দায়িত্ব পান ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতি শাকিল। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপ- প্রেসসচিবের দায়িত্ব পান তিনি। চার বছর পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) করা হয়। এরপর ২০১৪ সাল থেকে অতিরিক্ত সচিব মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
আইনজীবী-শিক্ষক দম্পতির সন্তান শাকিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ও আনন্দমোহন কলেজে পড়েছেন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে। সাবেক এই ছাত্রনেতা নিয়মিত কবিতা লিখতেন। ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ ও ‘মন খারাপের গাড়ি’ নামে তার দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, শাকিলের চলে যাওয়া গভীর বেদনাদায়ক। তার বয়স, সৃষ্টিশীলতা, সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা কোনোটাই চলে যাওয়ার মতো না। শাকিলকে হারিয়েছি। তার পড়ালেখা, লেখনী, শিল্প-সাহিত্যতে ভীষণ ক্ষুরধার ছিল।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দিন বাবলু বলেন, শাকিল বুদ্ধিমত্তা ও লেখাপড়ায় খুব মেধাবী ছিল। সে নেই, এটা মানা যায় না। তার মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। শাকিল চলে গেলেও তার সৃষ্টিশীলতা ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে আমরা তাকে ধরে রাখব।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাহবুবুল হক শাকিলও ছিলেন তাদের মধ্যে। মাহবুবুল হক শাকিল আগেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ছিলেন। এছাড়া শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। সম্পাদনা: মাহমুদুল আলম