এপির রিপোর্ট মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে হত্যা-ধর্ষণ গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার আরও বর্ণনা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুবতী মা বললেন, মিয়ানমারের সেনারা সকালে এসেছিল। তারা বাড়ি বাড়ি আগুন দিয়ে গ্রামবাসীকে একত্রিত হতে বাধ্য করলো। এ সময় দু-চারজন প্রতিবেশী মাঠের ভিতর দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেনারা তাদের গুলি করে। ভয়ে অন্য সবাই পালানো বন্ধ করে দেয়। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতার এমনই বর্ণনা দিচ্ছিলেন ২০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী মোহসেনা বেগম। তিনি যখন এ বর্ণনা দিচ্ছিলেন বারবার তার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। তিনি কেঁদে ফেলেন। তার বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ছোট্ট গ্রাম কাইরা ফারায়। সেই গ্রামের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। তার এ বর্ণনা তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা এপি। মোহসেনা বেগম বলেন, সেনারা আমাদের ঘর থেকে বের করে ফেলে। নারী ও পুরুষদের আলাদা লাইনে দাঁড় করায়। দুহাত পিছন দিকে ঘুরিয়ে মাথার পিছনে নিয়ে রাখতে নির্দেশ দেয়। এভাবে তারা প্রায় ৫০ জনকে এক জায়গায় জড়ো করে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্য ও স্থানীয়দের একটি গ্রুপ গ্রামের ৪ নেতাকে আলাদা করে। তারপর তাদের গলা কেটে হত্যা করে।
এপির রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার। তারা নাগরিকত্ব বঞ্চিত। অক্টোবরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে দেশটির একটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা হয়। তাতে ৯ সীমান্ত প্রহরী নিহত হন। এরপরই সর্বশেষ এ নৃশংসতা নেমে এসেছে রোহিঙ্গাদের ওপর। কারা ওই হামলা চালিয়েছিল তাদের চিহ্নিত
করা যায়নি। তাদের উদ্দেশ্যই বা কি তাও অস্পষ্ট। কিন্তু এমন অবস্থায় পাল্টা হিসেবে সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর শুরু করেছে মারাত্মক জোরালো অভিযান। রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারীদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম। এ এলাকাটি বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। এ অভিযানে পদাতিক বাহিনীকে সমর্থন দিতে আকাশে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। তা থেকে গুলি করা হয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন ও ওই নৃশংসতা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। তারা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সাহায্য চাইছেন। কিন্তু মিয়ানমার সরকার অব্যাহতভাবে একই কাহিনী বলে যাচ্ছে। তারা বলছে, মোহসেনা বেগমের মতো যেসব কাহিনী বলা হচ্ছে তা অতিরঞ্জিত। এই সহিংসতা জিইয়ে রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ও মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে দায়ী করছে। সিঙ্গাপুরের চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে তিনি সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সেখানে সু চি বলেছেন, পুলিশ আউটপোস্টে হামলা হয়েছে। সে বিষয়টি এড়িয়ে নেতিবাচক দিকটির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে কোনো লাভ হবে না। উল্লেখ্য, কয়েক দশকের সামরিক শাসনের পর গত মার্চে মিয়ানমারের ক্ষমতায় এসেছে সু চির দল। কিন্তু তার দেশে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ওপর যে নৃশংসতা চলছে তা বন্ধ করতে তিনি কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে কয়েক প্রজন্ম ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছেন। তারপরও তাদের দেখা হয় বাংলাদেশি হিসেবে। বলা হয়Ñ তারা অবৈধ অভিবাসী। অং সান সু চি ওই সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ঘটনা অতিরঞ্জিত না করে এসব জটিল পরিস্থিতির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। বাস্তবে যা ঘটছে বা ঘটেছে তার চেয়ে বেশি খারাপভাবে দেখানো হচ্ছে। যদি এ জটিল বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয় তাহলে তাতে উপকার হবে। কিন্তু মোহসেনা বেগম বলেন, তার গ্রাম কাইরা ফারা’তে যা ঘটেছে তা বাড়িয়ে বলার কোনো দরকার নেই। তিনি আরও বলেছেন, গ্রামের চার নেতাকে হত্যা করার পর গ্রামজুড়ে ভয়াবহ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মোহসেনা বেগমের স্বামী অশিক্ষিত। দরিদ্র শ্রমিক। তাকে প্রহার করা হয়েছে। তারপর তার গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে গ্রামের আরও অজ্ঞাতসংখ্যক মানুষকে। তারপর ওই মৃতদেহগুলো একটি ট্রাকে করে নিয়ে গেছে সেনাবাহিনী। মোহসেনা বেগম বলেন, হামলাকারীরা তার কাছ থেকে তার ছোট ছেলেকে কেড়ে নেয়। এরপর তাকে ধর্ষণ করে। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী যখন তার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয় তখন তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে দৌড়াতে থাকেন পাশের পাহাড়ের দিকে। সেখানে দুদিন পালিয়েছিলেন। তার ভাই তাকে প্রায় ৩৮ ডলারের মতো অর্থ দিয়েছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি যাতে পাচারকারীদের দাবি মেটাতে পারেন, তিনি ও তার ছেলে পাড়ি দিতে পারেন বাংলাদেশে। মোহসেনা বেগম এপিকে বলেছেন, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডরা তাকে থামিয়ে দিলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। মোহসেনা বেগমের ভাষায়, আমি তাদের বলি যে, আমাকে রক্ষা করার মতো কেউ নেই মিয়ানমারে। আমার শিশুটির দিকে তাকান! আমি যদি মিয়ানমারে ফিরে যাই তাহলে সে মারা যাবে! এরপরই আমি বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ পাই।
সহিংসতা শুরুর পর রাখাইনের বেশিরভাগই বাইরের মানুষ, বিশেষ করে সাংবাদিকদের নজর থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুনে তার সংবাদ সম্মেলন করার কথা রয়েছে। কিন্তু যে নাফ নদী বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমানা ভাগ করেছে সেখানে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন নয়, যারা রাখাইনের এসব নৃশংসতার বিষয়ে মুখ খুলবেন। এপির রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত মাসে প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা পৌঁছেছেন বাংলাদেশে। পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, তাদের এখানে নিয়ে আসছে পাচারকারীরা। ১৯৭০-এর দশক থেকে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এসে বসবাস করা শুরু করেন। এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তাদের কোনো কাগজপত্র নেই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওই ১৫ হাজার। ৩৩ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছেন কক্সবাজার জেলায়। ওদিকে জাতিসংঘ বলছে, সাম্প্রতিক সহিংসতায় মিয়ানমার থেকে বাড়িঘর ছেড়েছে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম। সম্পাদনা: ইমরুল শাহেদ