বেস্ট অফ লাক টু নাইম ভাই
যায়নুদ্দিন সানী
বেশকিছু দিন আগের কথা। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানকে কটাক্ষ করে তিনটি কলাম লিখেছিলাম। মূলত প্রথম লেখাটাই ছিল আমার নিজস্ব মতামত। বাকি দুটো ছিল বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার উত্তর। লেখাটায় বলতে চেয়েছিলাম, ‘কেন শুধু বসে বসে ঘাস কাটছেন, কিছু একটা করেন।’ এতো রূঢ়ভাবে বলিনি, তবে বক্তব্য এটাই ছিল। আমাদের অর্থনীতি আর আমাদের সময় ডট কম যেভাবে ঢিমে তালে চলছে, তা থেকে পত্রিকা দুটোকে বের করে আনতেই, চেয়েছিলাম নাঈম ভাই কিছু একটা করুক। আমার লেখা পড়ে রাগুক এবং সম্পাদকীয় কাজ আবার মনযোগী হোন কিংবা সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিন।
সেই লেখা প্রকাশিত হওয়ারও বেশ অনেক দিন হয়ে গেছে। এমন কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন পত্রিকা দুটোর ঘটেনি। সেদিন যখন দেখা হলো, উনি জানতে চাইলেন, ‘আজকের প্রথম আলো দেখেছেন?’ জানালাম, ‘না’। এরপরে তিনি বললেন, ‘দেইখেন। একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’ বাসায় এসে প্রথম আলো খুললাম এবং ভেতরের পাতায় সাদা কালোতে দেওয়া বিজ্ঞাপনটা দেখলাম। পড়ে প্রথমে মনে হলো, আমার লেখাগুলো পানিতে যায়নি। অবশেষে নাঈম ভাই হঠাৎ নড়ে চড়ে বসেছেন।
প্রথম আলোয় যে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন তা এখন তাঁর নিজের অনলাইন পত্রিকা আমাদের সময় ডট কমেও ঝুলছে। সম্ভবত ইংরেজি দৈনিকেও দিয়েছেন একই বিজ্ঞাপন। সৎ এবং সাহসী সাংবাদিকতার জন্য তিনি জনগণের সাহায্য চেয়েছেন। কীভাবে এবং কী করতে চাইছেন, খুব একটা খোলাসা করেননি। বিজ্ঞাপন মারফত দুটো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তিনি কিছু স্বেচ্ছাশ্রমিক চাইছেন আর দ্বিতীয়ত সৎ এবং সম্ভবত তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে সাহসী জার্নালিজম শুরু করতে চাইছেন। তথ্য দুটোকে একত্রে করলে সারাংশ দাঁড়ায়, পারিশ্রমিক দিয়ে সৎ এবং সাহসী জার্নালিজম সম্ভব না। ব্যাপারটা কি তাই? সম্ভবত।
আসলে পত্রিকা ব্যাবসাটা সেই অর্থে আর মোরালিটি ফোরালিটির ধার ধারে না। এক পাল লোক পুষতে হয়, অফিস ভাড়াসহ আরও যা খরচ আছে, সেসবের সংস্থান করতে হয়। এই খরচ জোগাতে হাতে আছে দুটো রাস্তা, পত্রিকা বেচা আর বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনের আছে দুটো উৎস, প্রাইভেট আর সরকারি। প্রাইভেট থেকে বিজ্ঞাপন আনতে চাই ব্যক্তিগত পরিচয় আর দাবি দাওয়া মেটানো। সরকারি বিজ্ঞাপন মানেই তো সরকারি পদলেহন কিংবা সরকারকে না চটিয়ে চলা। সো, চাইলেও সৎ আর সাহসী সাংবাদিকতা করতে পারছেন না। বিক্রি আপনাকে হতেই হবে, কোনো ধনকুবেরের কাছে আর নয়তো সরকারের কাছে।
এমন যখন পরিস্থিতি, তখন নাঈম ভাইয়ের বিজ্ঞাপন দেখে বেশ অবাক হলাম। আর্থিক সমস্যাটার এমন সমাধান কি সম্ভব? একরাশ লোক স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দিনের পর দিন কি কাজ করতে আগ্রহী হবে? আর তাও নিঃস্বার্থভাবে? পুরো ব্যাপারটা দেখে আমার অনুভূতি হচ্ছে, ভানুর সেই কৌতুকের মতো, ‘দেখি না ব্যাটা কী করে’। বিজ্ঞাপনটা আবার খুঁটিয়ে পড়লাম, সেটায় হতাশা বেশি, না প্রত্যাশা, তা নিয়ে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত। সেখানে যত না সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি বলা হয়েছে অক্ষমতার কথা। কিছুটা ধোঁয়াশাও আছে। স্পষ্ট করে বলেননি তিনি কী করতে চান। নতুন পত্রিকা? না অন্য কিছু।
একেবারেই নবিসদের নিয়ে, তাদেরকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তথ্য কিংবা রিপোর্ট সংগ্রহ করার একটা প্রচেষ্টা নেবেন এমনটা মনে হচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি এমন একটা অনুষ্ঠান করে, যেখানে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা মানুষরা তাঁদের এলাকায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ক্যামেরায় ধারণ করে পাঠায়, ব্যাপারটাকে বলা হচ্ছে সিটিজেন জার্নালিজম। তাঁর এই প্রচেষ্টার সঙ্গে ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ ফর্মুলার বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। জানি না, তাঁর মূল পরিকল্পনা কী, তবে এমন কিছু হলে, অবাক হব না।
সংবাদ পরিবেশন ব্যাপারটা এখন আর একচ্ছত্রভাবে পত্রিকার হাতে নেই। মুদ্রিত পত্রিকাই বলি কিংবা অনলাইন পত্রিকা, দুটোরই এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। যে কয়টি এলাকা থেকে এরা প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে, তাঁর একটি হচ্ছে ব্লগ আর অন্যটি সোস্যাল মিডিয়া। দেশের কোথাও বড় কোনো ঘটনা ঘটলে কেউ না কেউ তা নিয়ে একটা ব্লগ লিখে ফেলছে কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস ঠুকে দিচ্ছে। শেয়ার আর লাইকের বদৌলতে ক্ষণিকের মধ্যেই তা এক বিশাল পাঠকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অনেক সময় তো দেখা যাচ্ছে, পত্রিকাই খবরটা জেনেছে ফেসবুক কিংবা ব্লগ থেকে।
টুইটার এদেশে এখনো তেমন জনপ্রিয় না হলেও ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশেই খেল দেখাচ্ছে। ইন্সটাগ্রাম কিংবা ইউটিউবও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে আপাতত লিড করছে ফেসবুক। কারণ শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল, ফেসবুকের নাম কমবেশি সবাই জেনে গেছে। মোবাইলেও অনেকে বিভিন্ন ধরনের খবরের অ্যালার্ট সার্ভিসে সাবস্ক্রাইব করেন। মোদ্দা কথা, কেউই আর এখন পত্রিকা কিংবা টিভির নিউজের জন্য অপেক্ষা করেন না। তাৎক্ষণিক খবর জানার ইচ্ছেটাও যেমন একটা কারণ, তেমনি অপর একটা কারণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। ‘ব্যাটারা পয়সা খেয়ে লিখেছে’ কিংবা ‘এ তো সরকারের দালাল’ কোনো পত্রিকা পড়ে কিংবা চ্যানেলের খবর শুনে এমন মতামত এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
সো, সমাধান কী? দ্রুততার ক্ষেত্রে অনলাইন পত্রিকা হয়তো সোস্যাল মিডিয়াকে টেক্কা দিতে পারবে, তবে মূল সমস্যা থেকেই যাচ্ছে, ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’। পত্রিকাগুলোকে আমরা বেশ অনেক আগে থেকেই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি। ‘এটা বিএনপির পত্রিকা’ কিংবা ‘ওটা জামায়াত ঘেঁষা’ এমন মতামতও যেমন করি, তেমনি পত্রিকার মালিক কে, তা থেকেও একটা ধারণা তৈরি করে ফেলি, ‘এ তো লীগের পক্ষে লিখবেই’।
সো ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। গায়ে কোনো দলের ছাপ নেই এমন মালিক এবং পত্রিকায় সৎ এবং সাহসী রিপোর্টিং মনে মনে চাইলেও পাওয়া যে যাবে না, সে ব্যাপারে পাঠক অনেকটাই নিশ্চিত। ফলে কেউ কেউ ঝুঁকেছেন ব্লগ আর ফেসবুকের দিকে আর কেউ কেউ বিদেশি পত্রিকার দিকে। মাঝে মাঝে কোনো ঘটনা সম্পর্কে পত্রিকার আগে ফেসবুকই জানান দেয়। বিস্তারিত এবং খুঁটিনাটি তথ্য উপাত্ত নিয়ে অনেক সময় হাজির হয় ব্লগ।
তবে এসব ‘অল্টারনেট’ মিডিয়ার মূল সমস্যা হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। যে কেউ, যেকোনো খবর ছড়াতে পারে। তার ওপর ভিত্তি করে মন্দিরে হামলা থেকে শুরু করে ঘরবাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটে গেল। সমস্যাটা শুধু এদেশেই না, মার্কিন মুলুকও ভুগছে সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে। সাম্প্রতিক ইলেকশানে বেশকিছু মিথ্যা ছবি ট্রাম্প সাহেবকে জেতাতে কাজে লেগেছে। মোদ্দা কথা, তথ্যটা ভুল না সঠিক, তা বোঝার আগেই তথ্যটা তার কাজ সেরে ফেলছে। এবং সম্ভবত একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে, যারা সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করছেন। আর তা করতে গিয়ে তাঁরা এই মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতারও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।
ফলে আবার শুরু হয়েছে বাছ বিচার পর্ব। কোনো লেখা পড়ার আগে প্রথমেই দেখতে হচ্ছে, কে লিখেছেন। আগে তিনি কোনো রিউমার ছড়িয়েছিলেন কি না। কিংবা তাঁর লেখালেখিতে কোনো দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের লক্ষণ দেখা গেছে কি না। সবশেষে, তিনি সঠিক তথ্য দেন কি না। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই ব্যক্তিতেই ফিরে আসা। এমন কিছুর খোঁজ করা, যা বিশ্বাসযোগ্য। এমন কোনো লেখা, যার পেছনে কোনো ধান্ধাবাজি নেই। সরকার কিংবা বিরোধী দল, কারোর কাছ থেকেই কোনো কিকব্যাকের প্রত্যাশা নেই। নেই কোনো আনুগত্যের ছাপ।
নাঈম ভাই কি এই গ্রুপটাকে বেছে নিতে পারবেন? যারা কেবল দেশের জন্য কিছুর করার তাগিদ থেকেই লেখে। ঝুঁকি নিয়ে হলেও সোস্যাল মিডিয়ায় সত্য প্রকাশের চেষ্টা করে? শক্তিশালী কিংবা ক্ষমতাধর লোকদের বিরুদ্ধে লেখার সাহস দেখায়? উত্তর পাওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। টিল দেন, বেস্ট অফ লাক টু নাঈম ভাই।