তারা এখনও মূর্তিমান আতঙ্ক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদাবাজি চলছেই
বিপ্লব বিশ্বাস: তানভীর ইসলাম জয়, জাহাঙ্গীর ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, শাহাদাত, ডাকাত শহীদ, নাসির, বিকাশ, কিলার আব্বাস, মোল্লা মাসুদ, জিসান, আরমান, নবী হোসেন, মানিক, মুকুল ও সুব্রত বাইন। দীর্ঘ দুই দশক আগে থেকে আলোচিত-সমালোচিত এ নামগুলো রাজধানীবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। ধীরে ধীরে সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এ নামগুলোর সঙ্গে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’র তকমা যুক্ত হয়।
সাধারণ মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক এ নামগুলো রাজধানীর একেক এলাকার অপরাধ রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। আবার একাধিকজন মিলে সিন্ডিকেট করেও চালাতো রাজধানীর আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগত। রাজনীতি ও সরকারি দলের ব্যানারে এরা নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করত। সময়ের ব্যবধানে তাদের কেউ কেউ ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ক্রসফায়ার থেকে রক্ষা পেতে কেউ আমেরিকায়, কেউ নেপাল, কেউ ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। এদের মধ্যে কেউবা আছে কারাগারে। এখনো এদের নামে চলে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও গুম-খুন।
জানা যায়, দেশ সামরিক শাসনমুক্ত হয়ে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে থাকে। গণতন্ত্রের স্বাদ নিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কতিপয় নেতা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বাহিনী গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দিনে দিনে এসব বাহিনীর প্রধান ও সাঙ্গ-পাঙ্গরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত আন্ডারওয়াল্ডের মাধ্যমে রাজধানীকে সন্ত্রাসের স্বগরাজ্যে পরিণত করে। নগরবাসী যখন এসব শীর্ষ সন্ত্রাসীর সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ তখন নগরবাসীকে এদের হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারকেও নড়ে চড়ে বসতে হয়।
জানা গেছে, চারদলীয় জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৪২ জনকে চিহ্নিত করা হয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে তখন প্রথম দফায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাও প্রকাশ করা হয়। তাদের নামে ঘোষণা করা হয় পুরস্কার। এরপর সরকারে ও সরকারের বাইরে মন্ত্রীকে বিভিন্ন মহলের বেশ চাপে পড়তে হয়। পরবর্তীতে চাপের মুখে বাকি ১৯ জনের তালিকা প্রকাশ করেননি তিনি।
পুলিশ ও র্যাব সূত্রে জানা গেছে, এসব তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীর অনেকে পরবর্তীতে র্যাব-পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত বা আটক হয়েছেন। তাদের কেউ কারাভোগ করছেন, আবার কেউ জামিন নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকে আছেন দেশের বাইরে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে এখন তাদের দিন নেই। কিন্তু এখনো তাদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাস চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যায়। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম ভাঙিয়ে বর্তমানের চাঁদাবাজিকে এক ধরনের প্রতারণা বললেও একদম অস্বীকার করেননি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
বিভিন্ন সময় প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী দেশের বাইরে ও কারাবন্দি রয়েছেন তাদের নামেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি। এর মধ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভীর ইসলাম জয়, জাহাঙ্গীর ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর ও শাহাদাতের নামে চাঁদাবাজি চলে ‘ক্রাইম জোন’ হিসেবে পরিচিত মিরপুর এলাকায়। পল্লবী এলাকায় এখনো সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি হয় জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বিকাশ, কারাবন্দি কিলার আব্বাসের নামে। আর ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী নবী হোসেনের নাম। ধানমন্ডি, কলাবাগান, নিউমার্কেট ও হাজারীবাগ এলাকায় রয়েছে ইমন বাহিনীর একছত্র আধিপত্য। পুরান ঢাকার সদরঘাট, পোস্তগোলা, জুরাইন-শ্যামপুর-কদমতলী, কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, নবাবপুরে এখনো নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী ওমর ফারুক কচি, মুকু ও আলী আজগর বাবুলের নামে। পুরান ঢাকাসহ গোপীবাগ, স্বামীবাগ, ওয়ারী ও করাতিটোলাসহ যাত্রাবাড়ী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত ডাকাত শহীদ। তিনি ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর তার বিশ্বস্ত অনুসারীরা এখন সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। নাসির বাহিনীর দাপট কমেনি গোপীবাগে।
সূত্র জানায়, আত্মগোপনে দেশের বাইরে থাকা মোল্লা মাসুদের দখলে তেজগাঁও-মহাখালী এলাকা। এখানে চাঁদাবাজিসহ সব অপকর্মে ব্যবহার হয় তার বাহিনীর নাম। জিসান ও আরমানের নামে রামপুরা, খিলগাঁও ও মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে তার সহযোগীরা। মানিক বাহিনী তৎপর রয়েছে রামপুরা, বনশ্রী ও শাহজাহানপুরে।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ‘এখন দেশে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কোনো আধিপত্য নেই। এখন সবার মনোযোগ জঙ্গি ইস্যুতে। এক সময় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে পরস্পরের সংঘর্ষ হতো। এখন সে সব নেই। এখন নতুন করে যারা সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি করছে আমরা তাদের ধরছি। আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে।’ সম্পাদনা: সুমন ইসলাম