নতুন বছর আসার আগেই বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দেড় বছরেও মানা হয়নি হাইকোর্টের নির্দেশনা
এস এম নূর মোহাম্মদ: আর কদিন পরই আসছে নতুন বছর। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার পরিবর্তে উদ্বেগ কাজ করছে অনেকের মধ্যেই। বিশেষ করে ঢাকায় বসবাসরত ভাড়াটিয়াদের মনে এ উদ্বেগ অনেক বেশি। কারণ একটাই, বাসা ভাড়া। কেননা নতুন বছর আসলেই বাড়ে বাড়ি ভাড়া। কিন্তু আয় বাড়ে না।
এরই মধ্যে অনেক বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ভাড়াটিয়াদের। ফার্ম গেটে মেস করে কয়েকজন বন্ধুসহ থাকেন জামাল উদ্দিন। কথা হয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। জানান, তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ফ্ল্যাট ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। বাড়ির মালিক বলেছেন, জানুয়ারি থেকে থাকতে হলে ২৪ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হবে। তিনি বলেন, হঠাৎ করেই এত টাকা ভাড়া বাড়ানোর কথা বলছেন বাড়ির মালিক। কিন্তু আমাদের আয়তো বাড়েনি। তাহলে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য করবে কিভাবে সে প্রশ্নও করেন তিনি।
শুধু জামাল উদ্দিনই নন,এরকম অনেকেই পেয়েছেন বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ। যার কারণে পুরনো বাসা ছেড়ে সাধ্যের মধ্যে নতুন ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। কাজের ফাঁকে প্রায় প্রতিদিনই অলিতে-গলিতে হেঁটে চোখ বুলাচ্ছেন দেওয়ালের টু-লেট বা সাবলেট লেখা কাগজে। শুধু যে মেসের এ অবস্থা তা কিন্তু নয়। ফ্যামিলি বাসারও একই অবস্থা। তবে তুলনা মূলকভাবে বেশি সমস্যায় ভুগছেন ব্যাচলররা। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি ইস্যুতে এ সমস্যা আরও বেড়েছে। এখন অনেক বাড়ির মালিকই ব্যাচলরদের ভাড়া দিতে চান না। আর দিলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন।
অনেক ভাড়াটিয়া জানান, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে বাসা বা ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা অগ্রিমও নেওয়া হয়। আর এজন্য দেওয়া হয়না কোনো রসিদ। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কাজের খরচ, ইউটিলিটি বিল নেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না বাড়ির মালিকরা। সবই হয় মৌখিকভাবে। এমনকি বাসা ছেড়ে দিতে যে পরিমাণ সময় দেওয়ার কথা তাও জানানো হয়না তাদের। বিশেষ করে বাড়তি ভাড়া দিতে না চাইলে বা কোনো কিছুর প্রতিবাদ করলে তাৎক্ষণিকভাবেই বাসা ছেড়ে দিতে বলা হয় ভাড়াটিয়াদের। আর এ কারণে অনেক ভাড়াটিয়া বাড়ির মালিকদের সঙ্গে পারতপক্ষে তর্কে জড়াতে চান না। আর এসব বিষয়ে আইন অনুযায়ী দায়িত্ব না থাকার অজুহাতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনও দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ১ জুলাই নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। রায়ের ছয়মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে বলা হয়। কিন্তু দেড় বছর পার হলেও বাস্তবায়ন হয়নি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। গঠিত হয়নি কমিশন। নির্ধারণ করা হয়নি এলাকা ভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া। এরফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো সব কিছু করছেন বাড়ির মালিকরা এমনটাই অভিযোগ ভাড়াটিয়াদের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাড়াটিয়াদের কথা চিন্তা করে আমরা জনস্বার্থে এ মামলাটি করেছিলাম। বসবাস যে মৌলিক অধিকার এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আদালত একটি রায়ও দিয়েছিলেন। সেখানে কমিশন গঠন করে বাড়িভাড়া নির্ধারণ করার কথা বলেছেন। আমরা এখনো রায়ের সার্টিফাইট কপি পাইনি। যার ফলে আদালত অবমাননার নোটিশও দিতে পারছি না।
তিনি বলেন, বছর পেরিয়ে আবার জানুয়ারি চলে আসছে। এখন আবার ভাড়া বৃদ্ধি করবে। এতে ভাড়াটিয়াদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে। তবে সরকার চাইলে কমিশন করতে পারতো। রায় হলেও এর কোনো কার্যকারিতা আমরা পাচ্ছি না। রায়টা বের হলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে এবং এতে লাখ লাখ ভাড়াটিয়ার মানবাধিকার রক্ষিত হবে বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া ভাড়াটিয়াদে অধিকার আদায় নিয়ে আন্দোলন করা ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিবছর জানুয়ারি আসলেই বাড়ির মালিকরা ভাড়া বৃদ্ধির জন্য হা করে থাকেন। আমাদের কাছে অনেক ভাড়াটিয়া এরইমধ্যে ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। ভাড়াটিয়াদের বলবো আমাদের সঙ্গে ০১৭১৬৮১৫৯৯৫ ‘এ’ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য। যারা ভাড়া বৃদ্ধি করবেন এমন মালিকদের তালিকা তৈরি করে আমরা লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবো। আর ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণ না পেলে আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলেও জানান তিনি।
এর আগে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ বাড়িভাড়া নৈরাজ্য নিয়ে রিট দায়ের করে। শুনানি শেষে ওই বছরের ১৭ মে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এরপর ওই রুল শুনানি করে গত বছরের ১ জুলাই রায় দেয় উচ্চ আদালত। রায়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়ে আদেশে বলা হয়, কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। কমিশনের সদস্য থাকবেন সাতজন। সব শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলে, বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের মতামত নিয়ে প্রয়োজনে গণশুনানি করে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে কমিশন।
রায়ে আরও বলা হয়, গঠিত কমিশন যে সব সুপারিশ করবে, তা আইনি কাঠামোর রূপ না পাওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে বিশেষ করে ঢাকায় বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন করে নিয়ন্ত্রক নিয়োগ করবেন। সম্পাদনা : উম্মুল ওয়ারা সুইটি