ঢাকার পতন ছিল পরিকল্পিত ও ইচ্ছাকৃত, এর জন্য ভুট্টো-ইয়াহিয়া সমানভাবে দায়ী : এ.কে. নিয়াজী
জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। এ.কে. নিয়াজী নামেই যিনি বেশি পরিচিত। অনেকের কাছে টাইগার নিয়াজী নামে পরিচিত এই জেনারেল বাংলার মাটিতে নির্বিচার গণহত্যার অন্যতম খলনায়ক ছিলেন। টিক্কা খানের নির্দেশে ২৫ মার্চের নির্মম গণহত্যার কয়েক সপ্তাহ পরই ঢাকায় আসেন নিয়াজী। দায়িত্ব নেন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড প্রধানের। পরের ইতিহাস সবার জানা। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত তার নির্দেশেই পরিচালিত হয় পরিকল্পিত গণহত্যা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। ৩ ডিসেম্বর দুই ফ্রন্টে ভারতীয় আক্রমণ আর মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের পর পাকিস্তানের পরাজয় ঘনিয়ে আসে। মাত্র ১৩ দিনের সর্বাত্মক যুদ্ধে পরাজিত হয় পাকবাহিনী। রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন নিয়াজী। এরপর যুদ্ধবন্দি হিসেবে নিয়াজীকে কলকাতার ফোর্ট ইউলিয়াম দূর্গে নেওয়া হয়। ভারতে ২৮ মাস বন্দি থাকার পর দিল্লি চুক্তির আওতায় পাকিস্তান ফেরেন। দেশে ফিরেই নিয়াজীকে মুখোমুখি হতে হয় হামুদুর রহমান কমিশনের। সেনাবহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বন্ধ করা হয় তার অবসরকালীন ভাতা। বাতিল করা হয় সেনাবাহিনী থেকে তার নামে বরাদ্দকৃত জমি। নিয়াজীর শেষ জীবন খুব একটা ভালো কাটেনি। জীবনের বাকি ৩৩টি বছর অপমানের গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। ঢাকা পতনের জন্য একমাত্র তাকেই দায়ী করে থাকে পাকিস্তানিরা। একইসঙ্গে তার উপর নেমে আসে নানা নিবর্তনমূলক বিধি-নিষেধ। ১৯৯৮ সালে ‘বিট্রেইল অফ ইস্ট পাকিস্তান’ নামের একটি বই লেখেন। ২০০৪ সালের দুই ফেব্রুয়ারিতে ৮৯ বছর বয়সে মারা যান নিয়াজী। ২০০১ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পঠিত ইন্ডিয়ান-অ্যামেরিকার সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়া এ্যবরোড’ পত্রিকায় একটি বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন নিয়াজী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়া এ্যবরোড’ এর সাংবাদিক উত্তম ঘোষ। সাক্ষাৎকারটি নিতে সহযোগিতা করেছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক আমীর মীর।
প্রশ্ন: হামুদুর রহমান কমিশনের ফাঁস হওয়া কিছু তথ্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যেসব সেনাকর্মকর্তা একাত্তরের বিপর্যয়ের জন্য দায়ী তাদের বিচারের দাবি উঠছে জনগণের পক্ষ থেকে। আপনি কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবেন?
নিয়াজী: পাকিস্তানি জনসাধারণের দাবির সঙ্গে আমি একমত। ’৭১-এর পরাজয়ের জন্য যেসব সেনাকর্মকর্তা দায়ী তাদের অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারত থেকে ফিরে আসার পর আমি স্বতঃস্ফুর্তভাবে কোর্ট মার্শাল প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করেছি। আমি অনেক কিছু বলতে বা করতে চেয়েছি। কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল টিক্কা খান তাতে সম্মতি দেননি। তিনি চাননি ‘প্যন্ডোরার বাক্স’টি খোলা হোক। যুদ্ধের সময় জেনারেল হেড কোয়ার্টার এর ভূমিকা কি ছিল, রিজার্ভ আর্মির কমান্ডার হিসেবে টিক্কা খানের ভূমিকা কি ছিল, সেই বিষয়গুলো নিয়েও ভাবনার সুযোগ আছে। যার ফলে হামুদুর রহমান কমিশনের কার্যক্রমে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। যে সুযোগটি আমরা কোর্ট মার্শালে পেতাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আইন অনুযায়ী, কোনো আপদকালীন সময়ে যখন কারও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয়। সেই সময়ে জেনারেল হেডকোয়ার্টারের ভূমিকা ছিল খুবই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ। যে কারণে আমাদের কখনই কোর্ট মার্শাল করা হয়নি।
যদি কোর্ট মার্শাল হতো তাহলে খুব সহজেই আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারতাম। এছাড়া হামুদুর রহমান কমিশন আমার সঙ্গে একমত ছিল যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশেই আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন, হামুদুর রহমান কমিশন আপনার সঙ্গে একমত ছিল যে, সরাসরি ইয়াহিয়ার নির্দেশেই আপনি আত্মসমর্পণ করেছেন। কিন্তু জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সময়কালে প্রকাশিত নথিপত্রে বলা হয়েছে, এই বিপর্যয়ের জন্য বেশ কয়েকজন জেনারেলও জড়িত?
নিয়াজী: যদি আমি এই পরাজয়ের জন্য দায়ী হয়ে থাকি তাহলে কেন আমার কোর্ট মার্শাল হলো না? যদিও টিক্কা আমার সব ধরনের ক্ষতিই করেছে। কাসুরে আমার নামে বরাদ্দ দুই একর জমির বরাদ্দ বাতিল করেছে। ১৯৯১ সালে টিক্কা এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘জেনারেল অরোরার কাছে নিয়াজীর আত্মসমর্পণের কোনো কারণ ছিল বলে আমি (টিক্কা) মনে করি না। কিন্তু ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ ছিল। আমরা তাকে (নিয়াজী) সেনাবাহিনীতে ফেরত নিইনি আর প্রশাসনিক অ্যাকশান হিসেবে তাকে সাধারণ সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে অবসরে পাঠানো হয়েছে’।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানই এর জন্য দায়ী ছিলেন। আর আপনি শুধু তার অর্ডার মেনে চলছিলেন?
নিয়াজী: না তা নয়। ইয়াহিয়া ছাড়াও আরও কিছু মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের সংকটের জন্য দায়ী ছিল। যাদেরকে কোনোভাবেই দোষী করা হচ্ছে না। কমিশন কখনই পূর্বপাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মূল কারণ খতিয়ে দেখেনি। এক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতাও খুঁজে দেখা হয়নি। যাদের ব্যর্থতার জন্যেই ৭১ এ জিন্নাহর অখ- পাকিস্তান ভেঙে যায়।
প্রশ্ন: প্রতিবেদনটির শেষ অংশে বলা হয়েছে, আত্মসমর্পণের সরাসরি কোনো আদেশ ছিল না। যদিও কমান্ডার হিসেবে আপনি যে সংকটকালীন পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেছেন তাতে কর্তৃপক্ষ আপনাকে আত্মসমর্পণের কথা বিবেচনার কথা বলেছিল বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবেদন বলছে, আপনি ওই বিবেচনার কথাকে অমান্য করতে পারতেন যদি আপনি মনে করতেন যে আপানার পক্ষে ঢাকাকে রক্ষা করা সম্ভব।
নিয়াজী: আমি শপথ করে বলছি, আত্মসমর্পণের জন্য আমার প্রতি ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে সরাসরি আদেশ ছিল। যদিও আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম। এমনকি আমি বার্তাও পাঠিয়েছিলাম যে আমি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব। যদিও ১৪ ডিসেম্বর জেনারেল আব্দুল হামিদ খান ও এয়ার চিফ মার্শাল রহিম আমাকে ফোন করে হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বলে। কারণ সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানও বিপদাপন্ন ছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমি সিজ ফায়ার বা অস্ত্র বিরতিতে রাজি হই। যাতে সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। যদিও আমি আজও মনে করি দুইটা আর্মার্ড এবং তিন পদাদিক ডিভিশন সমন্বয়ে রিজার্ভ আর্মি যদি প্রতি আক্রমণ শুরু করত তাহলে এই যুদ্ধের ফলাফল অন্যরকম হতো।
প্রশ্ন: আপনার সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানে অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ, হত্যায় লিপ্ত ছিল। এই অভিযোগ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
নিয়াজী: পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব নেওয়ার পরই আমি এ রকম অনেক রিপোর্ট পাই। শত্রু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অগ্নিসংযোগ, লুট, ধর্ষণ ও হত্যার খবর পাই। পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে আমি ১৫ এপ্রিল ১৯৭১ হাইকমান্ডকে চিঠি লিখি। আমি স্পষ্ট করে লিখি যে, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, যা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরাও বাদ যাচ্ছে না। আমি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আরও জানাই যে, সেনা কর্মকর্তারা খুবই লজ্জাজনক কর্মকা-ে নিজেদের লিপ্ত করেছেন। বারবার চিঠি লেখা আর তাগাদা দেওয়ার পরও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই বিশৃঙ্খলা দূর করতে ব্যর্থ হন। আর এই প্রবণতা অবশ্যই আমাদের সেনাদের যুদ্ধ করার দক্ষতা নষ্ট করে।
প্রশ্ন: একজন সেনা কমান্ডার হিসেবে আপনি এই পরাজয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন। পাকিস্তানি সেনাদের এই লজ্জাজনক পরাজয়ে আপনি কি আপনার নিজের কোন দায়িত্ব স্বীকার করবেন?
নিয়াজী: আমার ৪৫ হাজার সেনা পাঁচ লাখ ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। সঙ্গে ছিল এক লাখ মুক্তিবাহিনী। অন্যদিকে শত্রুভাবাপন্ন জনগণ তো ছিলই। যুদ্ধ পরিচালনা ও দুষ্কৃতিদের দমনে আমার দরকার ছিল ৩ লাখ সেনা। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমরা এরই মধ্যেই হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তারপরও আমি যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। হামুদ (হামিদুর রহমান কমিশন প্রধান) যদি মনে করে থাকে আমরা পিকনিকে ছিলাম তাহলে তার উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, পূর্ব কমান্ডে সেনারা বীরত্বের সঙ্গে লড়েছে। যদিও এটা ছিল অমোঘ ক্ষমতার লড়াই। ক্ষমতা নেওয়ার জন্য এক দল মানুষ অস্ত্র তৈরি রেখেছিল। যা পূর্ণ হয় ৭১ এর পরাজয়ের মাধ্যমে।
একাত্তরের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। সে দ্বন্দ্ব ছিল ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছেন। ভুট্টো চেয়েছেন ক্ষমতা দখল করতে। এই টানাটানির মধ্যেই শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ বিশাল জয় পায় এবং সরকারের উচিত ছিল তাকেই ক্ষমতা দেওয়া। ভুট্টোর জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুধু রাজনৈতিকই ছিল না, তিনি যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা দিলে পাকিস্তান আজও অখ- থাকত। কিন্তু এটা খুবই পরিতাপের বিষয় যে, কমিশন ভুট্টোর কোনো দোষই খুঁজে পায়নি।
প্রশ্ন: কমিশন যেসব সেনা কর্মকর্তারা এই পরাজয়ের জন্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাদের প্রকাশ্য আদালতে বিচারের সুপারিশ করেছে। যদিও জেনারেল টিক্কা, সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান, রাও ফরমান আলী সব ধরনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারা কি নিরপরাধ ছিলেন?
নিয়াজী: এই তিনজনকে মুক্ত করার বিষয়ে কমিশনের মতামতের সঙ্গে আমি একমত নই। আমি অবাক হই এই ভেবে যে, পাকিস্তান ভাঙার জন্য টিক্কা, সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান, রাও ফরমান আলী, এই তিনজনকে কোনো দোষই দেওয়া হলো না। যদিও ইয়াকুবের কমান্ড আর নির্দেশের কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতি অত খারাপ হয়েছিল। সবকিছুকে গুলিয়ে ফেলার পরও ইয়াকুবেরও তেমন কিছু হয়নি। জাতির সঙ্গে প্রচারণার জন্য ইয়াকুবের ফাঁসি হওয়া প্রয়োজন ছিল। ইয়াহিয়া তাকে শাস্তি দিয়েছিল পদ অবনতি করে। যদিও ভুট্টো তার র্যাংক পুনঃস্থাপন করেন। নিযুক্ত করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।
হামুদুর রহমান কমিশন তাকে সব ধরনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয়। যখন একটা কঠিন সময় তখন দায়িত্বপালন না করে পদত্যাগ করায় তাকে পুরস্কৃত করা হয়। অন্যদিকে টিক্কার কথা ওই প্রতিবেদনে কিছু বলাই হয়নি। যদিও ২৫ মার্চের ঘৃণ্য গণহত্যার জন্য সে কসাই হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিল। কমিশন তার জঘণ্যতম ভূমিকা দেখেনি। রাও ফরমান আলীও সবকিছুতেই অবহিত ছিলেন। ঢাকার সব অপারেশনের দায়িত্ব ছিল তার উপর।
প্রশ্ন: ভুট্টো সরকার কেন হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ করেনি? আপনি কি মনে করেন?
নিয়াজী: ভুট্টো ভীত ছিল। এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো সে নিজেও পাকিস্তান ভাঙার জন্য দোষী সাব্যস্ত হতেন। ভুট্টোর অনুগত একটা উপ-কমিটি এই প্রতিবেদন দেখার সুযোগ পেয়েছিল। ওই কমিটিও প্রতিবেদনটি প্রকাশের পক্ষে মত দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও পরবর্তীতে ভুট্টো ওই প্রতিবেদনের ৩৪ পৃষ্ঠা নিজের মতো করে লেখান।
প্রশ্ন: তার মানে আপনি উল্লেখ করেছেন হামুদুর রহমান কমিশন প্রতিবেদন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ভুট্টো এতে প্রভাব খাটিয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা পতনের জন্য যেসব জেনারেলরা দায়ী ছিল তাদের কেউ বিচারের চেষ্টা করেনি। এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে আপনার কি কোনো পরামর্শ আছে?
নিয়াজী: ৭১ এর পরাজয়ের জন্য দায়ীদের জন্য চিহ্নিত ও বিচারের জন্য একটা আলাদা কমিশন গঠন করা জরুরি। যারা বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখবে। এটা সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে হতে হবে। থাকবে দুটো আলাদা সিন্ডিকেট। এটা খুবই আগ্রহ উদ্দীপক কাজ হবে। এখান থেকে অনেক কিছুই শেখা যাবে। সেনাবাহিনীর ভিতরেও খতিয়ে দেখতে হবে যে, কেন পূর্ব পাকিস্তানে কম সেনা, কম জনবল আর কম সরঞ্জাম দিয়ে বিশাল একটা যুদ্ধ করতে কেন দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। অন্যদিকে কেন পশ্চিম পাকিস্তানে যথেষ্ট সেনা-সরঞ্জাম আর পদক্ষেপ থাকা সত্ত্বেও তারা মাত্র ১০ দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার ভূমির দখল হারিয়েছিল।
১৯৭৪ সালে ভারতের বন্দি দশা থেকে ফেরার পর আমি যখন আমার প্রতিবেদন তৈরি করছিলাম তখন আমি বারবার শুনতে পাই পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড সেই সময়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। বিস্তৃত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের অনেকেই পূর্বাঞ্চলের ব্যর্থতার দায় স্বীকারেও নাকি প্রস্তুত ছিল। সেই সময়ই আমার সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। আমি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারি, হেড কোয়ার্টারের ইস্টার্ন কমান্ডের অনেকেই হাইকমান্ডের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ভুল তথ্য দিয়েছে, ভুল পথে পরিচালিত করেছে। এমনকি ভারতীয় মেজর জেনারেল সবেগ বেগ সিং’ও আমাকে বলেছিলেন আপনার সামনে অনেক সমস্যা আছে। এখানেই শেষ নয়। এই অধ্যায়ে তারা সব দোষ তোমার উপর চাপাতে চায়। এরপরই আমি নিশ্চিত হই যে, পূর্ব পাকিস্তানের পতন অনেক আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল।
প্রশ্ন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের পতন ইচ্ছাকৃতভাবে করানো হয়েছিল’ এই বক্তব্যের পেছনে আপনি কি যুক্তি বা তথ্য উপাত্ত দিতে পারেন?
নিয়াজী: ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফল অনুযায়ী ইয়াহিয়া দেখতে পায়, মুজিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। আর ভুট্টো নিজেকে দেখতে পান বিরোধী দলের ভূমিকায়। যা ওই দুইজনই চাননি। ফলে ওই দুজন ভুট্টোর লারকানার জমিদার বাড়িতে বসে একটা ষড়যন্ত্র করেন। যা লারকানা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। পরিকল্পনা ছিল, অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা, হুমকি দেওয়া, সবশেষ সেনা ক্ষমতা প্রয়োগ করা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ভুট্টো ও ইয়াহিয়া একমত হন যে, ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট আর ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করে যাবেন। আর পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হবে একটি অন্তবর্তী সরকারের মাধ্যমে। যখন ঘোষণা করা হলোÑ নির্বাচিত গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে ঢাকায়, তখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর উপর চাপ প্রয়োগ করা হলো যাতে তারা এই অধিবেশন বয়কট করেন। শেষ অঙ্কে তাদের এই পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত হয়। সফল হয় ষড়যন্ত্র।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন ভারত-পাকিস্তান এই দুই দেশকে সব ধরনের বিভেদ ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত। ভুল বোঝাবুঝির অবসানে চালানো উচিত সংলাপ?
নিয়াজী: ভারতের উপর বিশ্বাস রাখা কখনই আমাদের উচিত হয়নি। ভারতের কোনো সরকারই শক্তিশালী পাকিস্তান দেখতে চায়নি। তারা সবসময়ই পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা বলে যে পূর্বের সব সরকারই সবসময়ই পাকিস্তানের ক্ষতি করেছে। ভবিষ্যতেও যদি ভারত কোনো সুযোগ পায়, সেই সুযোগের অবশ্যই সদ্ব্যবহার করবে দেশটি। বর্তমানে কাশ্মীরে কি ঘটছে জঙ্গি দমনের নামে সেখানে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হচ্ছে। অন্যভাবে চিন্তা করলেও পাকিস্তানকে অবশ্যই কোনো শান্তি আলোচনায় যাওয়া উচিত নয় যতক্ষণ না ভারত জাতিসংঘের প্রস্তাবনা অধীনে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত না হয়।
প্রশ্ন: যদি আপনাকে সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে কি আপনি কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে চলমান কূটনৈতিক তৎপরতায় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী?
নিয়াজী: না। ভারতের সঙ্গে কোনো সমঝোতার বিষয়েই আমি আগ্রহী নই। তবে আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, যুদ্ধের জন্য আমি শারীরিকভাবে উপযুক্ত নই, কিন্তু তারপরও যদি আমি সুযোগ পাই তাহলে জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে আমার সৈন্যদের আমি নেতৃত্ব দেব।
‘সাইমন ড্রিং ও অন্যান্যের একাত্তর’ নামে প্রকাশ হতে যাওয়া একটি বইয়ের জন্য সাক্ষাৎকারটি সংকলন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রভাষক ও সাংবাদিক রাহাত মিনহাজ। ২০০১ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পঠিত ইন্ডিয়ান-অ্যামেরিকার সংবাদপত্র ‘ইন্ডিয়া এ্যবরোড’ পত্রিকাকে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এ.কে. নিয়াজী।
তথ্য সহায়ক:
া মূলধারা একাত্তর (১৯৮৬), মঈদুল হাসান । ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
া মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর (২০১০), গোলাম মুরশিদ। ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন।
া আমি বিজয় দেখেছি, এম আর আখতার মুকুল।
া তাজ উদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা (২০১৪), শারমিন আহমদের। ঢাকা: ঐতিহ্য
সম্পাদনা: আশিক রহমান