জাতীয় সংসদ ভবন, জলে যার প্রতিবিম্ব কংক্রিটের স্থাপত্য, শৌর্য বীর্যের প্রতীক
রাশিদ রিয়াজ: জাতীয় সংসদ ভবন বিশ্বের সেরা স্থাপত্যগুলোর অন্যতম এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অনেককে বলতে শুনেছি জাতীয় সংসদের পাশে যে ক্রিসেন্ট লেক ও সংসদ ভবনের ছাদ পাকিস্তানের প্রতীক চাঁদতারার সঙ্গে মিলিয়ে নকশা করা। বিষয়টি মনের মধ্যে বিঁধে থাকা চোরাকাঁটার মত মাঝে মাঝে খচখচ করত। এটাতো ঠিক পাকিস্তান আমলেই জাতীয় সংসদ ভবন তৈরি হয়। সন্দেহ ছিল মনে, হয়ত সে কারণেই সংসদ ভবন নির্মাণের নকশায় পাকিস্তানি প্রতীক প্রাধান্য পেলেও পেতে পারে। কিন্তু আমার মত এ ভুল রয়েছে অনেকের। এবং এ নিয়ে এখনো ভ্রম থাকা কখনোই উচিৎ নয়। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে টেলিফোন করি দেশের প্রখ্যাত স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে। আমার প্রশ্ন শুনে হেসে দিলেন তিনি। কৌতুক করে বললেন, চাঁদ তারা হলে ক্ষতি কি? ঢাকা শহরের অধিকাংশ মসজিদের দিকে তাকালে গম্বুজের সঙ্গে চাঁদ তারা দেখা যায়। আমরা চান্দ্রমাস অনুসরণ করি। চাঁদ দেখে রোজা রাখি। কিন্তু এর সঙ্গে সংসদ ভবনের নকশার কোনো মিল নেই। কেউ বললে তা হবে ‘টুইস্ট’ করা, অপব্যাখ্যা। আরেকটু অনুনয় করতে স্থপতি বললেন, আসল কথা। জানালেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কান জাতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের আগে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করতে অন্তত এক বছর গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন। নৌকায় করে নদী, খাল, বিল তন্ন তন্ন করে তিনি বাংলাদেশের প্রকৃতির সঙ্গে মিশেছেন। অত:পর লুই আইকান বাংলাদেশের সংস্কৃতি ধারণ করেছেন এই সত্যের মধ্যদিয়ে যে, এ বদ্বীপটির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে জল অর্থাৎ পানি। লক্ষ্য করলে দেখা যায় জাতীয় ভবনটি জলের ভিতর থেকেই উঠে এসেছে। পানি ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব যে নেই- তাই ফুটে উঠেছে সংসদের নকশায়।
বাংলাদেশে বন্যার সময় গ্রামে যেমন একটি কুঁড়ে ঘরকে পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকতে দেখা যায়, এমনকি রাজধানী ঢাকাকেও বন্যার সময় পানির মধ্যে অসংখ্য বাড়ি-ঘর সম্বলিত একটি শহর মনে হয়, এধরনের বিশাল ক্যানভাসের সাথে সংসদ ভবনের এক দারুণ মিল রয়েছে।
এরপর খোলা সবুজ মাঠ। প্রথম আরসিসি কংক্রিটের ভবন। চারপাশে লাল ইটের তৈরি ভবন। জলাশয় ও খোলামেলা এক আবহ রাখা হয়েছে তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখতে। স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন আরও বললেন, এধরনের কংক্রিটের স্থাপত্য শৌর্য, বীর্য ও একাত্মতার প্রতীক। মহাস্থানগড় থেকে অনেক প্রাচীন নির্মাণ স্থাপত্য লক্ষ্য করলে দেখবেন লাল ইট ও পোড়ামাটি বা টেরাকোটা আমাদের নির্মাণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য যা লুই আইকানের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে। পুরো সংসদ ভবনটিও স্থানীয় নির্মাণ উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যা এক ঐশ্বর্য্যশালী নির্মাণ প্রতীক হয়ে আছে।
অনেকদিন আগে বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা বিদেশি লেখক জেমস জে নোভাকের বই পড়েছিলাম যার নামটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ জলে যার প্রতিবিম্ব’। সংসদ ভবন নির্মাণে বাংলাদেশের পানি, সবুজ ঘাস, খোলা মাঠ অর্থাৎ প্রকৃতি ও পরিবেশের সাযুজ্য রয়েছে যা নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।