দুর্বল ব্যবস্থাপনায় চলেছে বংশাল নৈশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
রিকু আমির: সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি নিয়ে চলছে বংশাল নৈশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সরেজমিন দেখা যায়, স্কুলটিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ন্যূনতম উপযুক্ত শিক্ষা পরিবেশের অভাব আছে।
৬০/২ বংশাল রোডে অবস্থিত এ বিদ্যালয়। সোমবার দুপুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়টির ভবন পাঁচ তলা। নিচ তলায় পৃথক অফিস ও ক্লাস রুম। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত- সব ক্লাস রুম। এর একপাশে পঞ্চায়েত কবরস্থান। এর আশপাশ জুড়ে মোটরসাইকেল, ব্যাগ, খাবার হোটেলসহ বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য ছোটবড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৭ সালে এ বিদ্যালয়ের জন্ম। সেসময় এখানে রাত্রিকালীন পড়াশোনা হতো। কর্মজীবী বয়স্ক ও নিরক্ষরদের পড়াশোনা করানো হতো এখানে। স্বাধীনতার পর এটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ২০০৪ সালে বিদ্যালয়ের ভবন সম্প্রসারণ করে বর্তমান অবস্থায় রূপ দেয় সরকার। বর্তমানে এর নামের সঙ্গে ‘নৈশ’ শব্দটি যুক্ত থাকলেও কার্যত এর নৈশকালীন কার্যক্রম নেই।
২০১৬ সালে এ বিদ্যালয়ের ছয়টি শ্রেণীতে ৬০ জন ভর্তি হলেও বর্তমানে চার শ্রেণীতে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩৯ জন, চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে পাঁচ জন। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির এমন চিত্র ১৫-২০ বছর ধরে চলছে। অথচ এর খুব কাছে আরও চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
দৈনিক আমাদের অর্থনীতির প্রশ্নে শিক্ষকরা অকপটেই বলেছেন, নৈশ শব্দের কারণে অভিভাবকদের কেউ কেউ দ্বিধায় পড়ে যান, এজন্য সন্তান ভর্তি করাতে আগ্রহ হারান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকায় ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্ভোগ এড়াতে নাম পরিবর্তন করাও সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থানগতভাবেও বিদ্যালয়টির পড়ে গেছে খুবই নাজুক অবস্থায়। সকাল থেকে রাত অব্দি প্রবল শব্দ ও বায়ূদূষণ বিদ্যালয়টির চারপাশে। এটা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ব্যাহত করে তৎক্ষণাত। স্বল্পসংখ্যক শিক্ষকরাও এ কারণে কুপোকাত। এছাড়া বিদ্যালয়টির খুব কাছাকাছি রয়েছে শামসাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মকিমবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বংশাল সরকারি বালক প্রাথমিক ও বংশাল সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এসবের পরিবেশ উন্নত নৈশ বিদ্যালয়ের চেয়ে। ফলে নিম্ন আয়ভিত্তিক স্থানীয় বাসিন্দারা সন্তানদের এখানে ভর্তি না করে ওই চার বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। বছরের প্রথমে ভর্তি করলেও অন্যত্র শিক্ষার্থীদের সরানোর জন্য মরিয়া। এমনকি পরিবেশগত সংকটের কবলে পড়ে শিক্ষকরাও এখানে চাকরি করতে চান না বলে জানা গেল। শুধু তা-ই নয়, এ বিদ্যালয় এখন পর্যন্ত মুখ দেখেনি কোনো অফিস সহকারী, দফতরি, দারোয়ান, নৈশ প্রহরী ও আয়া-বুয়ার। স্কুলের গেট তালাবদ্ধ-খোলা, পতাকা উত্তোলন থেকে সব কাজ করতে হচ্ছে শিক্ষকদেরই। শুধু ধুলাবালি পরিষ্কার করার জন্য মাসিক ১২০০ টাকা দিয়ে একজন অস্থায়ী নারী শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন শিক্ষকরা।
অন্যদিকে, বর্তমানে নিয়মিত ৩৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য আছেন চারজন শিক্ষক (প্রধান শিক্ষকসহ), আরেকজন অসুস্থতার কারণে ছুটিতে আছেন। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আমেনা বেগম দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে বলেন, কর্তৃপক্ষকে সব সংকটের কথা জানানো হয়েছে দফায় দফায়। কিন্তু সাড়া মিলছে না। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
সোমবার দুপুরে যখন বিদ্যালয়টিতে যাওয়া হয়, তখন তিনজন শিক্ষকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তারা হলেন- প্রধান শিক্ষক আমেনা খাতুন, শিক্ষক কৃষ্ণ কান্ত বাড়ৈ ও দেলোয়ার হোসেন। তখন তারা কর্মস্থল ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমেনা খাতুন জানান, ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় আমি ছিলাম ছুটিতে। শুধু শিক্ষক কৃষ্ণ কান্ত বাড়ৈ একাই শিক্ষার্থীদের ভর্তি কাজ সম্পন্ন করেছেন। নতুন নিয়োগ পাওয়া দেলোয়ার হোসেন যোগ দিয়েছেন জানুয়ারির শেষভাগে।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, আসলে এ বিদ্যালয় মৃত্যুর মুখোমুখি। এটাকে বাঁচিয়ে তোলার পথ নেই। ১৫-২০ বছর ধরে যে বিদ্যালয় এভাবে চলছে, সে বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করাই যুক্তিযুক্ত।
আবার অভিযোগও আছে- বিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ লুটপাটের। একটি সূত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী- বরাদ্দ আসে ঠিকই ৬০ জন শিক্ষার্থীর জন্য। সব অর্থ খরচ করা হয় না। প্রতি বছরই এ কাজ হচ্ছে। কিন্তু কোনো জবাবদিহিতার সম্মুখীন হচ্ছে না কেউ।
সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার হাসিনা আক্তার পারভীনের সঙ্গে সোমবার সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দৈনিক আমাদের অর্থনীতির প্রশ্নে স্বীকার করেন- স্কুলটির মুমূর্ষু অবস্থার কথা।
হাসিনা আক্তার পারভীন বলেন, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকরা চেষ্টা করছেন, যাতে ভর্তি ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। বর্তমানে এর একটি শিক্ষকের পদ শূন্য আছে বলে তিনি জানান।
তিনি আরও বলেন, আগামী বছরের শুরুতেই একটি ক্যাম্পেইন করার কথা আছে, শিক্ষার্থীদের ভর্তি বৃদ্ধিতে। বিদ্যালয় স্থায়ীভাবে বন্ধের কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেই। সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ দত্ত