ট্রাম্পের যুগে সত্য ও মিথ্যা
মুজতাহিদ ফারুকী: যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেকের চেয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি জিনিস খুব ভালো বোঝেন: সেটা হলো, ব্যাপক জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ঘটনাবলীর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এবং জনগণের ঐকমত্য রয়েছে এমন বাস্তবতা কেবল যে ক্ষতিকরই হবে তা নয়, এটি একটি সুযোগও হতে পারে।
জনগণের ঐকমত্য ভিত্তিক ওই বাস্তবতার ওপর গড়ে ওঠা এককালের প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন, উপাসনালয়, সরকার, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয় এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো বর্তমানে টালমাটাল অবস্থায় এমনকি ধসে পড়ার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করছে। কারণ মি. ট্রাম্পের নিজেরই বাস্তব ঘটনার ওপর খুব সামান্যই শ্রদ্ধা রয়েছে। সেজন্য বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করা তার জন্য খুবই সহজ। কিন্তু এমনকি মার্কিনিরাও যখন ‘ভুয়া খবর’ গোগ্রাসে গিলেছে, তখন এমন একটি বোধের জন্ম নিচ্ছে যে, কিছু একটা যেন হারিয়ে গেছে। উত্তর ক্যারোলাইনার এক ব্যক্তি দ্য টাইমস পত্রিকাকে বলেছেন, তিনি যখন অনলাইনে এমন সব খবরের লিঙ্কগুলো নিয়মিত দেখতেন যেখানে দাবি করা হতো যে, ‘হিলারি ক্লিনটন অভিযুক্ত হয়েছেন’ অথবা ‘মেক্সিকো তার দক্ষিণ সীমান্তে দেয়াল তৈরি করেছে’, তখন তার কেবলই মনে হতো ওয়াল্টার ক্রনকাইটের সেই সময়ের কথা যে সময় তিনি জাতির জন্য খবর পরিবেশন করতেন।
ওই ব্যক্তি একা নন; সেক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। মার্কিনিরা জানে, তারা খবরে যা কিছুই শুনছেন সেই একই জিনিস তাদের প্রতিবেশিরাও শুনছেন। কেব্ল টিভি এই অংশীদারিত্বমূলক অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিয়েছে এবং এরপর সোস্যাল মিডিয়া আমেরিকানদের জন্য স্বস্তি বোধ করা, ক্রুদ্ধ হওয়া বা আত্ম-অধিকারের নিজস্ব বলয়ে অবস্থান নেয়া সহজ করে দিচ্ছে।
সোস্যাল মিডিয়ার বিকাশ অনেক দিক থেকেই বেশ বড় একটি ঘটনা। তথ্যের অনিঃশেষ যোগান ও সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপায় রয়েছে এমন একটি পরিবেশে নাগরিকরা পরস্পরকে তথ্য জানাতে এবং বিনোদন দিতে পারে, খুব সহজে সংগঠিত হতে এবং তাদের নেতাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে। তবে এক্ষেত্রে এটিও সত্য যে, যখন প্রত্যেকেই নিজ নিজ তথ্যের প্রবাহ নিজের মতো করে প্রক্রিয়াকরণ করে নিতে পারে তখন বাগাড়ম্বরসর্বস্ব ব্যক্তিরা যেসব বক্তব্য জনগণের কাছে দিতে চায় ঠিক সেই রকম করে বানোয়াট কাহিনী খুব সহজেই ছড়িয়ে দিতে পারে।
আর এই কাজটিই করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার কাছে ঘটনা কোনো বিষয় নয়, জনগণের বিশ্বাস করাটাই আসল। অন্য যে কোনো একনায়কের মতোই প্রায়শ মিথ্যা বলে এবং রীতিমত খোলাখুলিভাবে মিথ্যা বলার মাধ্যমে তিনি নিজের অনুসারীদের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এটিকে আমরা অন্ধ বিশ্বাস বলতে পারি। কারণ লাখো মানুষ তার মিথ্যায় এতটাই প্রভাবিত হয়েছেন যে, তারা সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য করার চেষ্টাও বর্জন করেন। সেই মিথ্যাটা ‘দেশের নাগরিক নন এমন লাখো মানুষ অবৈধভাবে ভোট দিচ্ছে’, অথবা ‘দেশের অপরাধের হার’, কিংবা ‘ওবামার নাগরিকত্ব’ যে বিষয়েই হোক না কেন, প্রতিযোগিতার এক সংশয়ান্বিত বিশ্বে চিৎকার করে বলা ‘সত্য’ কেবল একটিই, নিজের নেতার কথায় আস্থা রাখা। মি. ট্রাম্প যেমনটা প্রায়শ বলতেন, “আমি একাই সব ঠিক করে ফেলতে পারি।”
নির্দেশনা দেয়ার জন্য ওয়াল্টার ক্রনকাইট যখন আর নেই তখন আমেরিকার জনগণ কীভাবে গণতন্ত্রের কাঠামোর মৌলিক উপাদান সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির দিকে ফিরে যাবে? একজন প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য রাজনীতিক যারা সত্যের ওপর গুরুত্ব দেন তারাই কেবল নিশ্চিতভাবে মার্কিনিদের জন্য সহায়ক হতে পারেন। এ ধরনের নেতৃত্বের অবর্তমানে যেসব গণমাধ্যম কারো সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে খবর প্রকাশ করে এবং যেসব নাগরিক নিজেদের নিয়ে ভাবেন তাদেরই আলোর দিশা দিতে এগিয়ে আসতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়