নাসির নগরের নাটের গুরু ‘আঁখি-ফারুক’ দুই প্রভাবশালীর ‘টাকা আর মতার’ দ্বন্দ্বের বলি রসরাজ
বিপ্লব বিশ্বাস: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসির নগরে মানুষের মাঝে ধর্মের দেয়াল তুলে বিভেদ সৃষ্টির নাটেরগুরু হিসেবে প্রশাসনের কাছে প্রমাণিত হয়েছেন হরিপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি ও হরিপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক মিয়া। এরমধ্যে একজন মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ছায়েদুল হকের অনুসারী।
‘আঁখি-ফারুক’ কেন নাটের গুরু! জানতে চাইলে নাসির নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাফর আহমেদ জানান, আল আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক জাহাঙ্গীর রিমান্ডে অনেক তথ্য জানিয়েছে। সেখান থেকেই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি জানান, স্থানীয় দুই প্রভাবশালীর ‘টাকা আর মতার’ দ্বন্দ্বের বলি হয়েছে রসরাজ, স্থানীয় হিন্দুদের বাড়ি-মন্দির এবং নাসির নগরে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক। নাসিররগরে হামলার ঘটনায় মোট ৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে আঁখি ও ফারুকের নামে দুটি সুনির্দিষ্ট মামলা হয়েছে। প্রশাসন এখনো তাদের খুঁজে পায়নি। তবে তাদের গ্রেফতারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম কাজ করেছে।
ওসি জানান, রসরাজ একটি মাছের বিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। আর ফারুক ওই বিলের একাংশের দায়িত্বে ছিলেন। বিলের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার জন্য আল আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক জাহাঙ্গীরকে দিয়ে ধর্মকে কটূক্তি করে লিফলেট তৈরি করে রসরাজের নামে প্রচার করা হয়। এরপর ফারুকের লোকেরাই রসরাজকে তার গ্রাম থেকে মারতে মারতে ধরে নিয়ে পুলিশে দেয় এবং সেই সময় ফারুক নিজেই প্রচার করেন রসরাজকে পুলিশের হাতে তুলে না দিলে গ্রামবাসী পিটিয়ে মেরে ফেলত। ফারুকের সঙ্গে আঁখির দ্বন্দ্ব থাকায় পাশের হবিগঞ্জ থেকে লাধিক টাকা খরচ করে ট্রাক ও লোক ভাড়া করে হিন্দুদের উপর হামলা চালানো হয় বলে জাহাঙ্গীর এমন তথ্য দিয়েছেন। ‘আঁখি-ফারুক’ দুজনই হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু ফারুক সমর্থন পাননি। মূলত এরপর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
এদিকে রিমান্ডে জাহাঙ্গীর জানিয়েছেন, আষিতোশ দাস নামের একজন রসরাজের ফেসবুক আইডি খুলে দেয়। আষিতোশ এবং জাহাঙ্গীর রসরাজের ফেসবুক আইডি পাসওয়ার্ড জানতেন। আষিতোশ একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্পে চাকরি করেন। তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা স্থানীয়দের এবং পুলিশের। নাসির নগরে ৪টি সার্বজনীন মন্দির রয়েছে। সেখানে কোনো হামলা হয়নি। হামলা হয়েছে ব্যক্তিগত মন্দিরগুলোতে। মূলত ব্যক্তি আক্রোশ থেকে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা করছেন নাসির নগর পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি কাজল দত্ত।
নাসির নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জাফর আহমেদ জানান, মোবাইলের সিপিও চেক করে দেখা গেছে রসরাজের মোবাইল থেকে ছবি আপলোড করা হয়নি। আল আমিন সাইবার ক্যাফের মালিক জাহাঙ্গীর ফটোশপের মাধ্যমে লিফলেট বানিয়ে রসরাজের নামে প্রচার চালান। জাহাঙ্গীর রিমান্ডে এ সব কথা স্বীকার করেছেন। আর এ ঘটনায় ফারুক ও জাহাঙ্গীর জড়িত। এদিকে রসরাজের গ্রাম পশ্চিম পাড়ার হিন্দুরা হামলার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, স্বাধীনতার সময়ও এমন ঘটনা ঘটেনি। মালতী দাস নামের একজন বলেন, ‘২৯ অক্টোবর রসরাজকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই মাইকে বলা হচ্ছিল, হিন্দুদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে। এরপর আমরা সবাই ভয়ে তিতাস নদীর ওপারে চলে যাই।’
৩০ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে হরিণবেড় গ্রামের পশ্চিম পাড়ার হিন্দু বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ওই দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে পূজা দাস নামের একজন বলেন, ‘রসরাজদের ঘরের কাছেই আমার ঘর। একদল লোক এসে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। আমাকে এসে বলল, দুই হাজার টাকা দে। তাহলে তোর ঘর ভাঙব না। আমরা গরিব মানুষ টাকা কোথায় পাব। চুপ করে ঘরের মধ্যে বসে ছিলাম, চোখের সামনেই সব কিছু ভাঙল।’
ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির, হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর-লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়। এ হামলার পাঁচদিনের মাথায় ৪ নভেম্বর একই এলাকার কয়েকটি বাড়িঘর ও মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়। হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারের ঘোষণা দেয় জেলা পুলিশ।