শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধী লালনকারীদের বিচারের সময় এসেছে
উম্মুল ওয়ারা সুইটি: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের প অবলম্বনকারীদের বিচারের সময় চলে এসেছে। যারা তাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা তুলে দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের যেমন বিচার হয়েছে, এদেরও বিচার হতে হবে। সময় এসে গেছে, দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলে গতকাল আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এ মন্তব্য করেন। জার্মানিতে এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অপরাধীদের বিচার হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলতে থাকবে, এই বিচার শেষ হবে না। যতই কৌশল আর ষড়যন্ত্র করুক না কেন, তাদের কেউ রা করতে পারবে না। কারণ, এটা ন্যায়সঙ্গত পথ। ন্যায় ও সত্যের জয় সবসময় হয়, হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের যারা লালন-পালন করেছে, যারা রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে, যারা তাদের হাতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পাতাকা দিয়েছে, তারাও সমান অপরাধী। এদের বিচার হতে হবে। আমি মনে করি, সময় এসে গেছে, দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমাদের মধ্যে যদি কিছু বেঈমান জন্ম না নিত, আর আল-বদর, আল-শামস বাহিনী তৈরি না হত, তাহলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পে কখনোই সম্ভব ছিল না বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পথ-ঘাট চেনা। তাদের পথ দেখিয়েছিল, তালিকা করেছিল এবং তুলে নিয়ে গিয়েছিল আল-বদর, আল-শামস আর রাজাকারের দল।
বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, যে চোখের ডাক্তার, তার চোখ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। যে হার্টের ডাক্তার, তার বুক কেটে হার্ট বের করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কত অত্যাচার নির্যাতন করে এই হত্যাকা-গুলো চালানো হয়েছিল, সে বীভৎস অবস্থা চিন্তা করলে সারা শরীর শিউরে উঠবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাদেরকে শেখ হাসিনা শিক হিসেবে পেয়েছিলেন তাদের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। বাংলা ডিপার্টমেন্টের শিক মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশাসহ অনেক শিককে তারা হত্যা করেছে। তাদের কাশ করেছি, টিউটোরিয়ালে ছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তখন আর পাকিস্তানি হানাদার বলা হতো না। বলা হতো হানাদার। কারা হানাদার বলার সুযোগ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলা যেত না। নতুন প্রজন্মকে এসব জানতে দেওয়া হতো না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের প অবলম্বন করে জাতিসংঘে বক্তব্য দেওয়া শাহ আজিজুর রহমানকে পরে জিয়াউর রহমানের সরকারের প্রধানমন্ত্রী করার কথাও শেখ হাসিনা বলেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে সামরিক অধ্যাদেশ দিয়ে সংবিধান সংশোধনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয় সেসময়। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ আংশিক সংশোধন করে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের ভোটের অধিকার।
শেখ হাসিনা আেেপর সুরে বলেন, যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায়, সে জাতি সামনে এগোবে কীসের ভিত্তিতে! … মুক্তিযুদ্ধের গান মানুষ ভুলেই যেতে বসেছিল, মুক্তিযুদ্ধের কথা ভুলেই যেতে বসেছিল। এমন দিন ছিল আমরা জয় বাংলা সেøাগান দিতে পারতাম না। আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হতো। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাতে দিত না। ভাষণ বাজালে সেখানে হামলা হতো।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদেরও স্মরণ করে দলীয় সভাপতি বলেন, প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই অগণিত নেতাকর্মী দিনের পর দিন সংগ্রাম করে গেছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর আর্দশ বুকে ধারণ করে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিলেন। আমি আপনাদের সামনে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। একটার পর একটা হামলা হয়েছে। আমাকে রা করেছে এই দলের নেতাকর্মীরাই। কখনো তো কেউ ভয় পেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। শেখ হাসিনা বলেন, সবাই বিকিয়ে যায়নি, সবাই বিকিয়ে যায় না, সবাই বিকিয়ে যেতে পারে না। তাহলে বাংলাদেশ এই জায়গায় আসতে পারত না।
মাঝখানে ‘কালো মেঘ’ এলেও তা সরে গেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আশা করি, এই মেঘের ঘনঘটা আর কখনো আসবে না। আর এলেও বাংলাদেশের মানুষ পারবে তা মোকাবিলা করতে।
বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, বিশেষ বিশেষ দিনগুলোয় আমি দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে বসি। একটা প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই খুঁজে পাই না। যে বাঙালির জন্য আমার পিতা সারাটা জীবন কষ্ট করলেন, তার বুকে কীভাবে গুলি চালানো হল! তাকে গুলি করে ওই সিঁড়ির ওপর ফেলে রেখে দিল! তিনি তো কোনোদিন এটা বিশ্বাসই করতে চাননি, ভাবতেও পারেননি যে, এই বাঙালির কেউ তার বুকে গুলি চালাতে পারে। শেখ হাসিনা বলেন, যখন কেউ জীবনের ওপর হুমকির বিষয়ে সতর্ক করতেন, বঙ্গবন্ধু সেসব আমলে নিতেন না। কতজন, কত সময়, কত কথা তাকে বলেছে।… উনি বলতেন, ‘ওরা আমার ছেলের মত, আমাকে কেন মারবে?’
শেখ হাসিনা বলেন, ১৬ ডিসেম্বর যাদের আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল, তারা ওই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় বক্তব্য রাখেন শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের ছেলে শাহীন রেজা নূর, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী প্রমুখ। কলামনিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করেন। সম্পাদনা : হাসিবুল ফারুক চৌধুরী