সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী, ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পাদক সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকা-, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘আমাদের অর্থনীতি’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজ পড়–নÑ সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ। পৃষ্ঠা – ৫।
আমি যেকোনো কাজ দ্রুত করতে পছন্দ করি। পছন্দ করি সবদিক বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় কাজ পরিচালনা করতে। দ্রুত বলতে এমন দ্রুত নয়, যে-দ্রুতগতি কোনো কাজকে অকাজে পরিণত করে দেয়। এখনকার কাজ পরে করব- এটা আমার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। ছোটবেলা থেকে আমি এমন নীতিবিরুদ্ধ। এ কারণে সব কাজই দ্রুত করি। দ্রুত করি, তবে সবকিছু গুছিয়ে। লোকজন আমার দ্রুত বাস্তবায়নের প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করেন, তাতে আমি দ্রুত সাড়া দিই এবং বলি- ভবিষ্যতের শুরু আজ থেকে নয়, এ মুহূর্ত থেকে, আগামীকাল থেকে নয় বরং এক্ষুনি। যখন লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এখনই আপনি সবকিছু করতে চাইছেন কেন? আমার উত্তর : কেন নয়? বিলম্ব করার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। আমার সময় কম কিন্তু অনেক কাজ। আমি সবসময় মনে রাখিÑ ঞড়সড়ৎৎড়ি রং ধহড়ঃযবৎ ফধু.১০৫ তাই আজকের কাজ আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা যাবে না।
যদি আমরা আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি, তাহলে আমাদের মধ্যে গড়িমসি ভাব এসে যাবে। যখন আমরা বুঝব, কোন্ প্রকল্প আমাদের দেশের জন্য কাজে আসবে, আমাদের অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাবে এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, আমাদের সে প্রকল্পটি কোনো প্রকার বিলম্ব ছাড়া দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তাছাড়া, যা আজ শুরু করা দরকার তা আজ শুরু না করলে কাল আর শুরু না-ও করা যেতে পারে। সময় কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আগামীকালের জন্য ফেলে রাখা কাজ সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আর একটা কাজ সামনে চলে আসার কারণে সেটাই গুরুত্ব পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু যেটা শুরু করার কথা ছিল, সেটা ঠিক সময়ে শুরু না-করতে পারায় তা পিছিয়ে গেল। ভিত হয়ে গেল নড়বড়ে। এটা ঠিক হলো না। তাই যে কোনো কাজ সময়মতো সময়ের মধ্যেই করে ফেলা সমীচীন। শেক্সপিয়রের ভাষায় বলতে পারি : ইবঃঃবৎ ঃযৎবব যড়ঁৎং ঃড়ড় ংড়ড়হ ঃযধহ ধ সরহঁঃব ঃড়ড় ষধঃব.
বাংলাদেশ মাত্র সাড়ে চার দশকের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে সারাবিশ্বে। তা নিয়ে ভাবতে হবে। কীভাবে এমন অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছে! কারণ বাংলাদেশে এমন অনেক নেতা ছিলেন এবং আছেন যাঁরা বিলাসিতা করার চেয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আমরা কোনো কাজের বিলম্ব করায় অভ্যস্ত ছিলাম না। আমরা উন্নয়ন প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই, কারণ আমরা বিশ্বাস করি- একটি রাষ্ট্র যখন আর্থনীতিকভাবে শক্তিশালী হয়, তখন তার রাজনীতিক সক্ষমতা বেড়ে যায়।
সবাইকে কাজে, দায়িত্ব পালনে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। যথাযোগ্য মর্যাদা পেলে ঐক্য বাড়ে, বাড়ে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা এবং কাজ করার স্পৃহা।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার সম্মিলত প্রচেষ্টা ছাড়া, আমাদের দেশের এ অভূতপূর্ব অর্জন কখনও সম্ভব হতো না। প্রত্যেকটি নাগরিকের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবচেয়ে নি¤œপর্যায়ের কর্মচারীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো অর্জনই সম্ভব হতো না। তাই কাজে, দায়িত্ব পালনে সবাইকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে। যথাযোগ্য মর্যাদা পেলে ঐক্য বাড়ে, বাড়ে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা এবং কাজ করার স্পৃহা।
দ্বিধাগ্রস্ত মানুষদের জন্য ভবিষ্যৎ বসে থাকে না। আমরা অধিক অর্জন করতে পারি। যে পরিমাণ উপলব্ধি করি, সেই পরিমাণই অর্জন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। এটা প্রত্যেকের উচিত, যদি তিনি চান অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকতে, সম্পদে আর উন্নয়নে। তবে কাজ শুরু করা কিংবা কাজের সংখ্যা নয়, কতটা কাজ কতটুকু
সফলতার সঙ্গে সমাপ্ত হলোÑ এটাই মূল বিবেচ্য বিষয়। ওঃ’ং হড়ঃ যড়ি সধহু ঃযরহমং ুড়ঁ ংঃধৎঃ ঃযধঃ সধশব ুড়ঁ ংঁপপবংংভঁষ. ওঃ’ং যড়ি সধহু ড়িৎঃযযিরষব ঃযরহমং ুড়ঁ ভরহরংয.১০৬
আমি এখানে আমার একটি ব্যক্তিগত কাহিনি বলতে চাই। আমি যখন এলাকায় যাই, তখন হাজার হাজার মানুষ আমাকে দেখার জন্য, আমার কথা শোনার জন্য জমায়েত হয়। আমি তাদের সঙ্গে যখন কথা বলি- ওই সময়ে, সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেটা আমি করি। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেÑ এ পর্যন্ত আপনার লক্ষ্য-অর্জন কতটুকু সম্ভব হয়েছে। একবার একজন জানতে চেয়েছিলেন আমি আমার লক্ষ্যের শতকরা কতটুকু অর্জন করেছি। আমি প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ব্যর্থ হই। প্রশ্নটি সহ¯্র জনতায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বলেছিলাম, আমার আকাক্সক্ষা ছিল অনেক, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের এলাকার জনগণেরও অনেক প্রত্যাশা ছিল বা আছে। আমার লক্ষ্যমাত্রা প্রতিনিয়ত পূরণ হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত আবার প্রত্যাশার পরিবৃদ্ধি ঘটছে। যত প্রাপ্তি তত প্রত্যাশা, আমি অনেক পাচ্ছি এবং প্রাপ্তি আমাকে আরও পাওয়ার উৎসাহে উদ্দীপ্ত করছে। আমাদের আরও অনেকদূর যেতে হবে। আমাদের পথ অনেক, তবে সে পথ ধরে যাবার জন্য অনেক রথ রয়েছে আমার। তাই লক্ষ্যস্থল আমার কাছে অধরা কিছু নয়।
আমি যখন যোগাযোগ মন্ত্রী হই, তখন অনেক নতুন প্রকল্প শুরু করি, যা বাংলাদেশে এর আগে কখনও হয়নি। কয়েক বছরে আমি অনেক কাজ করেছি। আমি স্যাটল ট্রেন, মেট্রো রেলের ঘোষণা দিয়ে কাজ শুরু করার কথাও বলেছি। এখন সেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। আমি শুরু করেছি যেগুলো, এত কিছুর পরও আমি সব কাজ শেষ করতে পারিনি। মাঝখান থেকে আমাকে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারনে সরে যেতে হয়েছে। অবশ্য দেশের স্বার্থে শেষাবদি সেটা আমি স্বেচ্ছায় করেছি। এই কারণে নিজের কাছেই নিজে প্রশ্ন করিÑ যা করতে চেয়েছিলাম, তার কত শতাংশ অর্জন সম্ভব হয়েছে।
উত্তরে আমি বলি, যা আমি অর্জন করেছি তা আমার, উন্নয়ন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া, আমি কতটুকু অর্জন করেছি সেটি না-ভেবে বরং এটিই ভাবা উচিত, আমার অবদানের পরবর্তী পদক্ষেপ কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার গৃহীত পদক্ষেপগুলো যদি আমার উত্তরসূরি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনÑ তাহলে আমি শতভাগ সফল। আমাদের কাজের পরিধি বেড়েছে, আমাদের লক্ষ্য আরও বিস্তৃত হয়েছে, আমাদের দিগন্তরেখা আরও প্রসারিত হয়েছে এবং আমাদের উপলব্ধি আরও স্বচ্ছ হয়েছে। তবে দিন দিন স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বাড়ছে বলে আমাদের কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়ে পড়ছে।
উন্নয়ন ও প্রত্যাশা জীবনের দীর্ঘ যাত্রা, যার শুরু আছে শেষ নেই। প্রতিটি সময়ে আমরা কাজের একটি অংশ সম্পন্ন করি, আর এর মধ্যেই নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচিত হয়। কোনো প্রকার বিশ্রাম ও থেমে যাওয়া ছাড়াই আমাদের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। থেমে যাওয়া মানে সময় নষ্ট করা। আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করব। আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাই, আমরা যেন দেশের জন্য কিছু রেখে যেতে পারি এবং আমাদের পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ সেবাটা যেন দেশকে দিয়ে যেতে পারি।
কোনো প্রকার বিশ্রাম ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আমরা আমাদের কাজ নিরন্তরভাবে করে যাব। থেমে থাকা মানে সময় নষ্ট করা। তাই থেমে থাকা যাবে না। কাজের মাঝে ক্লান্তি এলে বিশ্রাম নেওয়া যাবে। তবে তা যেন আলসেমি না হয়। এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে- ভবিষ্যতের শুরু আজ, কাল নয়।
একটি আদর্শ সরকারের লক্ষ্য হচ্ছেÑ দেশের নাগরিকদের সুখে রাখা। তা করার জন্য দ্রুত কাজ করতে হবে। কোনো কাজে বিলম্ব হলে তাতে কোনো সুখ নেই। গড়িমসি ও অবহেলায় কতগুলো দিন নষ্ট হয়েছে তার হিসাব করতে হবে। সেই হিসাবে একটা মুহূর্ত আর নষ্ট করা যাবে না। দেরিও করা যাবে না।
আবার আমরা বিষয়ে ফিরে যাই, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে নাগরিকদের সুখে রাখা। সুখের জন্য কোনোকিছু বিলম্বে করা যাবে না। সময় খুবই মূল্যবান, তাই একে নষ্ট করা যাবে না। আমাদের নাগরিকদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণে সময়কে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যয় করতে হবে। আপনাকে অবশ্যই অপেক্ষা বা বিলম্বিত দিনগুলোর সংখ্যা বের করতে হবে এবং গড়িমসি করে কত সময় নষ্ট করা হয়েছে তা গণনা করতে হবে। আমাদের নাগরিকরা কেন লক্ষ লক্ষ দিন দ্বিধায় এবং প্রতীক্ষায় নষ্ট করছে? কেন আমাদের নাগরিকদের বিলাসিতা, সুখ এবং আরামকে বিলম্বিত করছে, এসব বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী চিন্তা করেন। তাই জনগণ এখন অনেক সচেতন। তারা বলে, আমাদের সফল প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার কারণে তারা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমি বলি দ্রুত, অগ্রসর হওয়াÑ একটি সফল জাতির গুণ। যারা সময়ের গুরুত্ব দেয় এবং পেছনের দিনগুলোকে মূল্যায়ন করেÑ তাদের সাফল্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একটি সফল জাতি নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়, চারপাশের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে না। পরিস্থিতিকেও সে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। একটি সফল জাতি ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করে না, বরং নিজেকে উপস্থাপন করে এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। একটি সফল জাতি আজকের কাজকে আগামী দিনের জন্য রেখে দেয় না, বরং আগামী দিনের কাজ আজই করে ফেলে।
[ আগামীকাল পড়–নÑ পর্যটন ও ভ্রমণ]