সেবা ও শিক্ষার চেতনা ছড়িয়ে দেয় ওয়াজ
হুমায়ুন আইয়ুব: বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন দেখিনি। দেখিনি একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামও। বায়ান্ন কিংবা একাত্তর না দেখলেও আঁতুরঘরে মায়ের কোলে মাতৃভাষায় চিৎকার করেছি। জন্মের পর প্রথমেই বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়েছি স্বাধীন বাংলা মায়ের। আমার প্রথম চিৎকার ছিল বাংলায়। মায়ের ভাষায়। যে ভাষায় আজ প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ কথা বলে।
এই ভাষা আমার। এই দেশ আমার। এই লাল সবুজের পতাকা আমার। আমার মন-মনন, চিন্তা চেতনা ও আদর্শের আঙ্গিনা জুড়ে এই রক্তাক্ত লাল সবুজ পতাকা। মায়ের ভাষা ও ছাপান্ন হাজার বর্গ মাইলের প্রতিটি কণা সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের। আলেমদের। বললে বাড়িয়ে বলা হবে না, বায়ান্ন থেকে আজ মাতৃভাষার অবিরাম অগ্রযাত্রার কা-ারি এই আলেম সমাজ। বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করা, বিশ্ব দরবারে পরিচিত করার প্রধান কাজটি এই আলেমরাই করে আসছেন। তবে ছন্দ পতনও অস্বীকার করবো না। দেশের আলেমদের যাপিত জীবনের ভাষা বাংলা। তারা বাংলায় কথা বলেন। কুরআনুল কারিম ও হাদিসগ্রন্থ বুখারি থেকে শুরু করে পুরো ইসলামের সিলেবাস বাঙালির সামনে বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করেছেন আলেমরা। আলেমদের মিম্বারের ভাষা বাংলা। ওয়াজের ভাষা বাংলা। রাতবিরাত ওয়াজ করেন মায়ের ভাষায়। দেশের মানুষের আত্মিক ও মানসিক শক্তি যোগায় ওয়াজ। আলেমদের বয়ানে সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমে। মানুষ আল্লাহমুখি হয়। ইসলামের উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক মূল্যবোধের সবক আলেমদের ওয়াজ। ওয়াজই সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয় সৃষ্টির কল্যাণ ভাবনা, সেবা ও শিক্ষার চেতনা। মসজিদের মিম্বার থেকে সবুজ মাঠ, উঁচু মিনার থেকে সাদা সামিয়ানা সব জায়গায় আলেমরা বাংলা ভাষায় ওয়াজ করেন। দ্বীনের দাওয়াত দেন মায়ের ভাষায়।
বাংলা ভাষার ওয়াজ নিয়ে কথা হয় কয়েকজন খ্যাতিমান ওয়েজির সঙ্গে। এক পড়ন্ত বিকালে ঢাকার ধলপুরে নিজ কার্যালয়ে কথা হয় মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) ছিলেন আফসাহুল আরব বা আরবিদের মাঝে শ্রেষ্ঠতম সুভাষী। নবীজির উত্তরসুরি আলেমরাও উম্মতের দরদি অভিভাবক। আলেমরাও সুভাষায় মানুষদের দ্বীনের দাওয়াত দিবেন। ওয়াজ ও বয়ানে বাংলা ভাষার দূষণ রোধ করবেন।
ওয়াজে কি ধরনের বাংলা ভাষার দূষণ হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা সেলিম আজাদি বলেন, জনসাধারণের অতি আবেগের কারণে অল্প শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত লোকজন ওয়াজের সুযোগ নিচ্ছে। শিশু বক্তা, অন্ধবক্তা, ষোল ইঞ্চি বক্তা, মহিলা পুরুষ হয়েছে এমন চটকদার বক্তার কদর সমাজে বেশি। বিষয়টা হলো তাদের অধিকাংশই পড়ালেখা জানেন না। মাতৃভাষার জ্ঞানও কম। সুরেলা গলায় ভুলভাল বাংলা বলেন। সমাজের শিশুরা সেগুলোই মুখস্থ করে। এই ভুল বলাটা বাংলা ভাষাকে চরমভাবে দূষিত করছে।
‘বাংলা ভাষার দূষণ তো শুধু ওয়াজেই হচ্ছে না, অশিক্ষিত গায়ক, ভুল উচ্চারণের কণ্ঠশিল্পী, কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাদের অসতর্ক ঝগড়া অতপর ভুল বাংলা বলা, খ্যাতিপ্রবণ অনেক মূর্খ অভিনেতার ডায়ালগ থেকেও দূষিত হচ্ছে বাংলা ভাষা’ সামগ্রিকভাবে বাংলাভাষার দূষণ প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী এমন প্রশ্নের জবাবে মাওলানা সেলিম আজাদি বলেন, বাংলা ভাষাকে দূষিত করা মানে বায়ান্নের ভাষা শহিদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করা। যে যার জায়গা থেকে সচেতন হলে ভাষার দূষণ অনেকটা কমে আসবে।
ওয়াজে উর্দূ আরবি ফারসি কবিতার ধারাকে চিরায়ত ও ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ কওমী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক, বিখ্যাত ওয়েজি মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাকী। তিনি বেসুরা সুর ও পল্লিগীতির মতো ভাব আবেগ ছাড়া ওয়াজের সমালোচনা করে বলেন, আলেমরা মানুষের হেদায়াতের জন্য ওয়াজ করেন। উপমহাদেশে সুফি সাধকরা চিরায়ত ধারায় দীর্ঘদিন ওয়াজ করে আসছেন। মানুষের বলার ভাষা বাংলা, তাই আলেমরা ওয়াজও বাংলায় করেন। কুরআন হাদিসের ভাষা আরবি মানুষকে কুরআনের কথা বলতে হলে তো আরবির স্বাদ দিয়ে বলতে হবে। তাছাড়া আল্লামা রুমি, জামি, গাজ্জালি, হাসান বসরি, শেখ সাদি ও আল্লামা ইকবালের মতো পৃথিবীখ্যাত মুসলিম মনীষীরা কেউই বাঙালি নন, তাদের মর্যাদাশীল কথার স্বাদ বাঙালি শ্রোতাদের দেওয়ার জন্য আলেমরা আরবি ফারসি উর্দূর ব্যবহার করেন। শ্রোতাদের আসল স্বাদ দেওয়ার জন্য ওয়াজে আরবি ফারসি উর্দূর এই ব্যবহার বাংলাভাষাকে দূষিত করে না বরং বিশ্বসাহিত্যের ব্যাপকতায় সমৃদ্ধ করে। তবে বিশুদ্ধ বাংলা বলায় আলেমদের আন্তরিক হতে হবে। বাংলাভাষায় রচিত ছড়া-কবিতার ব্যবহার ওয়াজে প্রাধান্য দিতে হবে। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম