এই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত স্পর্শ করে বলতে ইচ্ছে হয়, মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি
একাত্তর সালে যে নারী যোদ্ধারা অসম সাহসিকতায় সরাসরি ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিলেন তাদের এই সংপ্তি তালিকাটি তৈরি করেছি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকা, বই, জার্নাল এবং সাাৎকার ঘেঁটে। কয়েক হাজার বীর সেনানী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝ থেকে অন্যতম সেরা দশ নারী যোদ্ধার নাম এবং তাদের যুদ্ধত্রে, ট্রেনিং সম্পর্কে সংপ্তি বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলোÑ
তারামন বিবি: একাত্তর সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সী কিশোরী এই মুক্তিযোদ্ধা অসংখ্য সফল অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন যেগুলোর মধ্যেÑ রাজীবপুর, বদরেরপুর, মদনেরপুর, দশঘরিয়াপাড়া, চকনেওয়াজী অপারেশন উল্লেখযোগ্য। যুদ্ধ চলাকালীন এই অসম সাহসী কিশোরী যোদ্ধা কাজ করেছেন গুপ্তচর হিসেবেও। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতার জন্য ‘বীর প্রতীক’ খেতাব পাওয়া দুইজন নারী মুক্তিযোদ্ধার একজন।
কাঁকন বিবি: ১৯৭১ সালে ৫ নম্বর সেক্টরে লক্ষ্মীপুর ক্যাম্পের নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি ছিলেন খাসিয়া মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের পর যিনি পরিচিত হন ‘খাইস্যা মুক্তি বেটি’ নামে। জর্ডিয়া ব্রিজ ধ্বংস করার কৃতিত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তার। বেশিরভাগ সময় তিনিই শত্রু এলাকায় গ্রেনেড বহনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করতেন। মহব্বতপুর, কান্দাগাঁও, বসরাই, টেংরাটিলা, বেটিরগাঁও, নুরপুর, দোয়ারাবাজার, টেবলাই, সিলাইরপাড়সহ বিশটিরও বেশি সফল অপারেশনে যুদ্ধ করেছেন, বয়ে বেড়িয়েছেন গোলা-বারুদ। এখনো তিনি পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তবে কয়েকটি পত্রিকা, নারী সংগঠন, প্রবাসী বাঙালি সংগঠন এই অকুতোভয় যোদ্ধাকে নানাভাবে সম্মানিত করেছে।
বীথিকা বিশ্বাস ও শিশিরকনা: পাক আর্মির বেশকিছু গানবোট উড়িয়ে দেওয়াসহ অসংখ্য অপারেশনে ৯ নম্বর সেক্টরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন এই দুই নারী যোদ্ধা। তারা পুরুষ যোদ্ধাদের পাশাপাশি লড়েছেন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে। ১০০ জন মেয়েকে নিয়ে গড়ে ওঠা গেরিলা যোদ্ধা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন এই দুই অকুতোভয় নারী যোদ্ধা।
আলেয়া বেগম: ’৭১ সালে এই কিশোরী যোদ্ধার বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর। রাইফেল, বন্দুক, এসএমজি, এলএমজি, এসএলআর সবকিছু চালানোতেই দারুণ পারদর্শী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আলেয়া বেগম, ছিলেন ইউনিট কমান্ডার। চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, সহযোদ্ধা রেজাউল করিম যোদ্ধা হিসেবে আলেয়া বেগমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কয়েকটি সম্মাননা পেয়েছন তিনি, কিন্তু পাননি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
মেহেরুন্নিসা মিরা: বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মেজর তাজুল ইসলামের কাছে অস্ত্র চালনা ও ডিনামাইট বিস্ফোরণের প্রশিণ নিয়ে দশমহল, মাহুতকান্দা, বড়ইগুনা, খালিশপুর, বেসরগাতী, ভুটাপুর, সন্তোষপুর এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সাতাশ বছর পর অকুতোভয় এক যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র কাছ থেকে।
হালিমা খাতুন: মুক্তিযোদ্ধা হালিমা খাতুন ১৯৭১ সালে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন এবং একইসঙ্গে সমানভাবে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন। বাবা ও স্বামীও ছিলেন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ২৮ বছর পর এই দরিদ্র বৃদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র কাছ থেকে। স্বীকৃতিতে বলা হয়Ñ ‘মুক্তিযুদ্ধের সাতাশ বছর পর সম্মাননা প্রদানের এই উদ্যোগ মহান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতীয় পর্যায়ের উপো ও উদাসীনতার লজ্জা সামান্য পরিমাণে হলেও লাঘব করবে।’
করুণা বেগম: বরিশালের মুলাদি থানার কুতুব বাহিনীর ৫০ জনের নারী মুক্তিযোদ্ধা দলের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগম। মুক্তিবাহিনীর গ্রুপ লিডার হিসেবে বরিশাল জেলার কসবা, কাশিমাবাদ, বাটাজোর, নন্দীবাজার, টরকীতে শত্রুর সঙ্গে খ-যুদ্ধে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। পাকবাহিনীর গুলিতে পা হারান যুদ্ধাহত এই অসম সাহসী নারীযোদ্ধা।
আলমতাজ বেগম ছবি: একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি যুদ্ধ করেছেন আটঘর, কুড়িয়ানা, গরঙ্গল, পেয়ারা বাগান প্রভৃতি রণাঙ্গনে। খুলনাতেও একাধিক অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন এই নারী। স্বামী সেলিম শাহনেওয়াজ, কবি হুমায়ূন কবির ছিলেন বড় ভাই, তাদের দুইজনেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরের রণাঙ্গনে থাকা এই অসম সাহসী নারী পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তবে সম্প্রতি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ায় বর্তমান সরকার তার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের সিদ্ধান্ত নেয়।
সখিনা খাতুন: কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সখিনা খাতুন। কখনো ভিখারিনী, পাগলিনীর বেশে গুপ্তচরবৃত্তি করেছেন, ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার কয়েক বছর আগের এক এক সাাৎকারে এই যুদ্ধকান্ত যোদ্ধা বলেছেন, ‘জানতাম জিতবই। জিততে না পারলেও সবার সঙ্গেই শহিদ হয়ে যেতাম। একাত্তরের রাজাকারদের যেমন দেখেছি আজও তাদের প্রতিপত্তি একটুও কমেনি, দুঃখ লাগে এটাই। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো দেখা হলে নানী বা খালা ডাকে, সম্মান করে এটা সেটা খাওয়ায়। এতে খুবই সম্মানিত মনে হয় নিজেকে।’
এই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে স্পর্শ করে বলতে ইচ্ছে হয়, মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। নারীদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। বিশ্বাস রাখোÑ অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দিইনি!
লেখক ও ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর, মাইক্রোসফট
ফেসবুক থেকে