টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়
এস.ইসলাম জয়: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাদের গবেষণায় ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮টিতেই ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ করেছে সংস্থানটি। এ পদে নিয়োগে ৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে।
গতকাল রবিবার টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির দুই গবেষক দিপু রায় ও রেজাউল করিম। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়,ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মন্ত্রী,সংসদ সদস্য,বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক,ছাত্রনেতা,উপাচার্য,উপ-উপাচার্য,ডিন,বিভাগীয় প্রধানদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যদের। এছাড়া শিক্ষকের সন্তান,স্বামী,স্ত্রী,শ্যালক, শ্যালিকা ও আত্মীয়দের নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। অনিয়ম দুর্নীতির কেস স্ট্যাডি তুলে ধরে গবেষণাপত্রে বলা হয়,প্রার্থীকে চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে নিয়োগ সংশ্লিষ্ট একজন শিক্ষক বলেন,‘আমার কিছু লোন আছে, ওই লোন তুমি শোধ করে দিলে আমার ও তোমার দুইজনেরই উপকার হয়।’গবেষণায় উপচার্য,শিক্ষক নেতা,রেজিস্ট্রার অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারি,বিশেষজ্ঞ, ছাত্রনেতা,ক্ষমতাসীন দলের ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ এলাকা বিবেচনা করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাপেও নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিতে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষায় ফলাফল ইঞ্জিনিয়ারিং করে বেশি নম্বর দেওয়া হয়। পরবর্তীতে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের ঘটনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। তবে গবেষণাটি করা হয়েছে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নিয়োগের আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম শুরু হয়। নিয়োগ বোর্ড গঠন, সুবিধামতো যোগ্যতা পরিবর্তন বা শিথিল করা,জবাবদিহি না থাকার মাধ্যমে এই অনিয়মের শুরুটা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে,১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বোর্ড গঠনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের সুযোগ বিদ্যমান ছিল,
নিয়োগের আগেই আরও যেভাবে অনিয়ম শুরু হয়, তারও কিছু চিত্র তুলে ধরা হয় এই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, কোনো কোনো শিক্ষক পছন্দের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পরীক্ষার ফল প্রভাবিত করেন এবং পরবর্তী সময়ে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বাজার করাসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে আগে থেকেই একাডেমিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নারী শিক্ষার্থীর একাংশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে একাডেমিক পরীক্ষায় নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া,পরীক্ষার পূর্বে প্রশ্ন জানানো ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব অনিয়মের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর সুযোগ থাকলেও সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে সিন্ডিকেট নিয়োগ চূড়ান্ত করে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন,সার্বিক চিত্রটি হতাশাব্যঞ্জক ও উদ্বেগজনক। তিনি প্রভাষক নিয়োগে সমন্বিত ও পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ বিধিমালা করার দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে শিক্ষাবিদ ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন,‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে,যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা বাস্তব। কত শতাংশ অনিয়ম-দুর্নীতি হলো,সেটা বিচার করছি না। কারণ,নিম্ন মেধার একজন শিক্ষক নিয়োগ হলে প্রায় ৪০ বছর ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। তাই এ ধরনের একটি ঘটনা হলেও তা মানতে চাই না। এটি অশনিসংকেত।’
তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য নিয়োগে বিধিমালা প্রণয়নে যোগ্যতার মানদ- ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার উল্লেখকরণ,নিয়োগ প্রক্রিয়া শিক্ষক সমিতির প্রভাবমুক্ত করা,ফলাফল ইঞ্জিনিয়ারিং বন্ধ করা,নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তার প্রকাশ করা,আবেদনপত্রে প্রাথমিক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের যোগ্যতা গোপন না করে মেধাক্রম অনুযায়ী তালিকা প্রস্তুত করা,আবেদন জমার স্বীকারোক্তিপত্র দেওয়া,স্বচ্ছ নিয়োগ কমিটি গঠন করা,মৌখিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসার সময় অপছন্দের প্রার্থীকে অবান্তর প্রশ্ন না করা,নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যতজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা থাকবে ততজনই নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ড.সুমাইয়া খায়ের,ড. ইফতেখারুজ্জামান, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।