সাক্ষীর অভাবে নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না আলোচিত ও স্পর্শকাতর প্রায় সাড়ে চারশ মামলা
আনিসুর রহমান তপন: বছরের পর বছর শুনানির দিন সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে ঝুলে আছে প্রায় সাড়ে চারশ মামলা। দ্রুত এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে শুনানির দিন যথাসময়ে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক ও ৫৭ জন পুলিশ সুপারকে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্যের অভাবে ও তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও শুনানির দিন আদালতে হাজির করতে বাধ্য হচ্ছেন এসব দুর্ধর্ষ আসামিদের। নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যেও এসব আসামিদের নির্দিষ্ট দিনে আদালতে হাজির করার পরও শুধু সাক্ষীর অভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলা ঝুলে আছে বছরের পর বছর। এ কারণে স্পর্শকাতর এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে এবার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব স্মৃতি রানী ঘরামীকে প্রধান করে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, কমিটি সম্প্রতি ৫৭ জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের কাছে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে মামলার বিবরণ, কোন আদালতে বিচারাধীন, মামলার তারিখ, আসামি ও সাক্ষীর নামসহ বিস্তারিত তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। তাছাড়া কী কারণে নির্ধারিত দিনে আসামির বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী দিতে সাক্ষীরা উপস্থিত হচ্ছে না, তাও জানাতে বলা হয়েছে। আর যৌক্তিক কারণ উল্লেখসহ প্রতিবেদন না পাঠালে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে চিঠিতে।
এছাড়া আরেক চিঠিতে সারাদেশের কোন কারাগারে কতজন আসামি কোন মামলায় কতদিন আটক রয়েছেন, মামলার ধারা ও তাদের নাম, পরিচয়সহ বিস্তারিত পরিসংখ্যান এবং তথ্য-উপাত্ত দিতে কারা অধিদফতরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে যথাসময়ে সাক্ষীদের আদালতে হাজির করার মাধ্যমে বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে, কী কারণে নির্ধারিত শুনানির দিন সাক্ষীরা আদালতে হাজির হচ্ছে না, সে বিষয়টি বিশেষভাবে তদারকি করতে জেলা প্রশাসক (ডিসি)দের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া সরকারি নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীকে আরও সক্রিয় করে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তাছাড়া কাজের অগ্রগতি বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিয়মিত মনিটরিং করছে বলেও তাগিদপত্রে সতর্ক হয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
সম্প্রতি কারা অধিদফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, এমনিতেই কারাগারে আসামি ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি বন্দি সেখানে রয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গি ও বিভিন্ন দুর্ধর্ষ মামলার আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ জানায়, স্পর্শকাতর মামলার আসামি হিসেবে দেশের কারাগারগুলোতে ৪৬২ জন বন্দি আছে। আলোচিত ও স্পর্শকাতর মামলার আসামিদের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ জন, ময়মনসিংহে ২৫ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ১-এ ৪ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার২-এ ৫৭ জন, কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ জন, হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২১ জন, ফরিদপুরে ৫ জন, টাঙ্গাইলে ৩ জন, জামালপুরে ১ জন, কিশোরগঞ্জে ৮ জনসহ আলোচিত মামলার আসামি রয়েছে। এসব আসামির মামলার বিচার কাজ চলছে দেশের বিভিন্ন দায়রা জজ আদালতে।
তাছাড়া ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দি থাকাতেও রয়েছে নিরাপত্তা শঙ্কা। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, সারাদেশের কারাগারে বন্দিধারণ ক্ষমতা ৩৬ হাজার ৬১৪ জন। বিপরীতে বর্তমানে বন্দি আছে ৭৮ হাজার ২৯০ জন, কয়েদি ১৯ হাজার ৩৬৯ জন, হাজতি ৫৮ হাজার ৮৩২ জন, বিদেশি বন্দি আছে ৫৮৬জন।
এসব কারণে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে স্পর্শকাতর ও আলোচিত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে। এজন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সাহায্যও নিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আলোচিত কয়েকটি মামলা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র অন্যতম সদস্য ইয়ামিন মিয়াকে বিস্ফোরক দ্রব্যসহ আটক করে ২০০৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ ৯ বছর টাঙ্গাইল দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা চললেও সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় এই মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। একই মামলার আসামি মোজাহার আলীর ছেলে শহিদুল ইসলাম ও ইয়ামিন মিয়া এ পর্যন্ত টাঙ্গাইল বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জজ-২ আদালতে ৯০ কার্যদিবস শুনানিও হয়েছে।
সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের ফারুক হোসেন খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয় ২০০৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। তাকে এ পর্যন্ত ১২৫ বার আদালতে হাজির করলেও সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে এ মামলাটিও। ২০০৩ সালে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয় চুনারুঘাটের বাসিন্দা রাজু আহমেদ। এই আসামি বন্দি আছে জেলা কারাগারে। তাকে মোট ১০৮ বার মামলা নিষ্পত্তি করতে আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু প্রত্যেক বারই সাক্ষীর অভাবে এখনো অনিষ্পন্ন রয়েছে মামলাটি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় বাগেরহাটের কাকা মোল্লা বন্দি আছে ২০০৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। এ পর্যন্ত ৯০ বার আদালতে হাজির করা হলেও সাক্ষী হাজির হননি।
নাটোরে ২০০৫ সাল থেকে খুনের মামলায় আব্দুল খালেক কারাগারে রয়েছেন। সাক্ষী উপস্থিত না থাকায় ৭০ বার তাকেও আদালতে হাজির করা হয়। এরমধ্যে কেটে গেছে দীর্ঘ ১১ বছর। একই কারাগারে মাদক মামলায় বন্দি হয়ে আছেন নওশাদ ম-ল। তাকে ৮০ বার আদালতে হাজির হতে হয়েছে। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় এ মামলা দুটিও নিষ্পন্ন হয়নি।
খুনের অভিযোগে বরগুনার আব্দুল জলিল এবং নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় জাহাঙ্গীর আলম ২০০৯ সালের ৬ মে থেকে বরগুনা জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছে। এর মধ্যে তাদের দুজনকে ৯৪ বার আদালতে হাজির করা হয়। কিন্তু সাক্ষী হাজির না থাকায় এখনো নিষ্পত্তি হয়নি এ দুটি মামলা। তাছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি হিসেবে চাঁদপুর জেলা কারাগারে বন্দি আছে মো. জহিরুল ইসলাম। ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর থেকে আটক হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০ বার আদালতে হাজির করা হয়েছে তাকে। এ মামলাটিও সাক্ষীর অভাবে শেষ রায় দিতে পারছে না জেলা দায়রা জজ আদালত। একই আদালতে খুনের আসামি আব্দুল মান্নানকেও ৭০ বার আদালতে হাজির করা হয়। সাক্ষীর অভাবে এ মামলাটিরও একই অবস্থা।
চাঁদাবাজি ও খুনের মামলার আসামি বান্দরবান পার্বত্য জেলার বাসিন্দা রেজাউল করিম ও উবাসিং মারমা ২০১০ সাল থেকে আটক রয়েছে চাঁদপুর জেলা কারাগারে। সাক্ষীরা উপস্থিত না থাকার কারণে ১০৮ বার দায়রা জজ আদালতে শুনানি হলেও সাক্ষীর অভাবে এই মামলাটির পরিণাম একই।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নির্ধারিত তারিখে সাক্ষী উপস্থিত হয়ে সাক্ষী না দেওয়ায় দেশের বিভিন্ন আদালতে থাকা স্পর্শকাতর মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এর কারণ খুঁজে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিচারপ্রার্থীরা যাতে দ্রুত বিচার পায় সেজন্য সরকার সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট জেলার ডিসি ও এসপিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে সাড়ে চারশ বন্দির মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত, যাবজ্জীবন কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে দ-প্রাপ্তরাও রয়েছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে অন্যান্য মামলা আরও চলমান রয়েছে। কারাবন্দি এসব আসামির বিরুদ্ধে হত্যা, জঙ্গিবাদ, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, মাদক, বিস্ফোরকসহ গুরুতর একাধিক মামলা রয়েছে।