ইসলামে যৌথ পরিবার
হুমায়ুন আইয়ুব: নাই হয়ে যাচ্ছে যৌথ পরিবার। শহরে তো বটেই; গ্রামেও যৌথ পরিবার দেখা পাওয়া ভার। ছোট পরিবারও ঘরবন্দি। উত্তর আধুনিক জীবনের নির্মম আবিষ্কার ফ্লাটবন্দি। আমাদের সন্তানরা বাবা-মা ছাড়া তেমন কাউকে চিনে-জানে না। দাদা-নানার নামও গণিতের নামতার মতো ধীরে ধীরে বলে। ভুল হয়ে যাওয়ার আশংকায়! আমরা যারা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত; তারাও ভুলে বসেছি আত্মীয় স্বজনের মধুর বন্ধন। উন্নতি-অগ্রগতি আর ক্যারিয়ার গড়ার তাগিদে কাছে-পিঠের মানুষদের তেমন কোনো খোঁজ রাখি না; বা রাখতে পারি না। ঈদ-চাঁদে দেখা হলে কৃত্রিম ভালবাসার অভিনয়। ব্যস্ততার লম্বা তালিকা। শুনেই কাহিল স্বজনেরা। আমাদের এই নির্মম আচরণের শিকার বাবা-মাও। অথচ একজন বিশ্বাসী-মুমিনের জীবন হবে আত্মীয়-স্বজনের নিবিড় ভালবাসায় আচ্ছাদিত। ঘর দোয়ারে ভেসে বেড়াবে মায়ের হাসি, বোনের উচ্ছ্বাস, খালার মিষ্টি কৌতুক। নানি-দাদিরে গল্পের জন্য কান পেতে রাখবে আমাদের সন্তানেরা। বোন-ভাগ্নি, চাচা-চাচি, মামা-মামি, ফুফা-ফুফুসহ নিকট আত্মীয়দের আনাগোনায় সব সময় মুখরিত থাকবে ওঠান-ভিটা। স্বজনদের আনাগোনায় বহুমাত্রিক স্বাদ-আহ্লাদ আর মুগদ্ধতায় বাঙময় হয়ে ওঠবে জীবন। স্বজনের সঙ্গে বন্ধন অটুট রাখার জোর দাবি জানিয়েছে কুরআন। ইরশাদ হয়েছে, আর আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না, এ ছাড়া মাতা-পিতার সঙ্গে উত্তম আচরণ কর, আর বন্ধন অটুট রাখো নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে। (সূরা নিসা : ৩৬)
কুরআন আরও বলছে নিকট আত্মীয়ের অধিকার আদায় কর। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬)
কুরআন আরও বলছে, তোমরা শিগগিরই এ থেকে ফিরে যাবে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আর যারা এরূপ করবে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসবে। আর এ ধরনের লোকদেরকেই বধির এবং অন্ধ করে দেওয়া হবে। (সূরা মুহাম্মাদ: ২২-২৩)
কুরআনের জীবন্ত উদাহরণ আজকের সমাজ। আমরা আজ অন্ধ-বধির! মনেও নেই আত্মীয়-স্বজন আছে। সামান্য বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে বা রাগারাগি হয়েছে, কয়েক বছর চলে গেছে পরস্পর কথা নেই। দেখা নেই। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন।
অথচ নবীজি (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। (বুখারি : ৬১৩৮)
হাদিসে একটি গল্প এসেছে। এক ব্যক্তি নবীজি (সা.) কে এই বলে প্রশ্ন করলেন, হে, আল্লাহর রাসুল! আমার কতিপয় আত্মীয়! আমি তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলি অথচ তারা আমার সঙ্গে তা ছিন্ন করে, আর আমি তাদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করা সত্ত্বেও তারা আমার সঙ্গে মন্দ আচরণ করে। আমি তাদের ব্যাপারে সহিষ্ণুতার পরিচয় দিই অথচ তারা তার উল্টো করে। তখন নবীজি বললেন, তোমার অবস্থা যদি এরূপই হয় যা তুমি বললে, তা হলে তুমি যেন তাদের মুখে গরম ছাই নিক্ষেপ করলে। আর তাদের বিপক্ষে তুমি সব সময়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী পাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি এই অবস্থায় বহাল থাকবে। (মুসলিম : ২৫৫৮)
কানজুল উম্মাল গ্রন্থে উল্লেখ্য, হযরত আয়েশা (রা.) একজন বাদি মুক্ত করলেন। নবীজি বললেন, তুমি যদি বাদিটি মুক্ত না করে তোমার মামাদের দিয়ে দিতে তাও তোমার জন্য উত্তম ছিল। হযরত উসমান ইবনে মাজউন (রা.) বলেন, মহানবী আমাকে খুব ভালবাসতেন। তার ভালবাসায় মুগ্ধ হয়েই আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। একবার আমরা হুজুরের নিকট বসা। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। হঠাৎ তিনি ভিন্ন দিকে মনোযোগী হয়ে উঠলেন। গভীর মনোযোগ শেষে তিনি বললেন, হযরত জিব্রাইল এসেছেন। বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফ, সদাচার ও নিকট আত্মীয়দের দান করার আদেশ দেন এবং তিনি আশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও সীমালঙ্ঘন থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।’ (সুরা-আন নাহাল ৯০)
আমি কুরআনের এই আয়াত শোনে, ইনসাফ, ন্যায় বিচার ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মধুর আচরণের প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাড়ি ফিরছি। পথে নবীজির চাচা আবু তালেবের সঙ্গে দেখা। আবু তালেব মুসলিম ছিলেন না। নবীজির চাচা কে দেখে বললাম! আপনার ভাতিজার নিকট থেকে ফিরছি। তিনি ইনসাফ, ন্যায় বিচার ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মধুর আচরণের কথা বলেন। আবু তালেব বললেন, তোমরা মুহাম্মদের অনুসরণ করো। তুমি সফলকাম হবে! আল্লাহর কসম, তার নবুওয়াতের দাবি সত্য বা মিথ্যা হোক! তিনি তোমাদের ভাল অভ্যাস উত্তম চরিত্রের শিক্ষা দিচ্ছেন।
একজন অমুসলমানও বিশ্বাস করেন, ইনসাফ, ন্যায় বিচার ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মধুর আচরণ উত্তম শিক্ষা। আমাদের জীবন আলোকিত হোক স্বজনদের মধুর সম্পর্কে। ভুলে যাওয়া জীবনে আলো ছড়িয়ে পড়–ক স্বজনের হাসিতে। সম্পাদনা: সুমন ইসলাম